ব্যাগে প্রেমিকা ও তার সন্তানের টুকরো দেহ : আটক ব্যাংক ম্যানেজার
দুটো চাকা-লাগানো সুটকেস, একটা পিঠে-ঝোলানো ব্যাগ, আর একটা থলে। চার-চারটে ব্যাগ-সুটকেস সামলে ভুটভুটিতে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। টানাটানিতে একটা সুটকেসের হাতলও আবার ছিঁড়ে যায়। চারদিকের সাহায্যের হাত এড়িয়ে একাই সেগুলিকে তোলেন ভুটভুটিতে। কিন্তু মাঝগঙ্গায় আসতেই অবাক কাণ্ড। একে একে ফেলতে শুরু করেন সুটকেস।
কলকাতার শেওড়াফুলির তিন পয়সা ঘাটের কাছে সকাল সা়ড়ে ন’টায় হঠাৎই জমে ওঠে নাটক।
মাঝগঙ্গায় দুটো ব্যাগ ফেলতে ফেলতে ভুটভুটি ঘাটের কাছে চলে আসে। এর মধ্যে সহযাত্রীদের প্রশ্ন ছিটকে আসতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি সামলাতে ভদ্রলোক জানান, তিনি ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। ব্যাঙ্কের অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র বয়ে এনেছেন জলে ফেলে দিতে। সন্দেহ হতে সহযাত্রীরা শেওড়াফুলি ঘাটে তাকে আটকে রাখেন। খবর দেন পুলিশে। ঘাটের কাছাকাছি আরও দুটো ব্যাগ ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। সেগুলি তুলে আনার ব্যবস্থাও করেন তারা।
তখনও কিন্তু কারও ধারণা ছিল না, কী আছে ওই সুটকেস দু’টিতে। সেগুলি খুলতেই চোক্ষু চড়কগাছ! বেরিয়ে পড়ল এক মহিলার পেট পর্যন্ত ধড়ের অংশ আর নিম্নাংশ! শেওড়াফুলি ফাঁড়ি থেকে পুলিশ এলে এর পরে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল ওই লোকটিকে। বছর পঁয়তাল্লিশের সমরেশ সরকার। দুর্গাপুরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। সপ্তাহশেষে ফিরছিলেন ব্যারাকপুরে নিজের বাড়িতে।
এর পর সারাদিন ধরে সমরেশবাবুকে জেরা করে পুলিশ। তাকে নিয়ে রাতে দুর্গাপুরে তার কর্মক্ষেত্রেও যায়। দীর্ঘ জেরায় সমরেশবাবু জানান, দেহাংশ তার প্রেমিকা সুচেতা চক্রবর্তীর। কিন্তু একই সঙ্গে দাবি করেন, খুন তিনি করেননি। তা হলে? সমরেশবাবুর কথা অনুযায়ী, শুক্রবার দুপুরে তিনি দুর্গাপুরের বিধাননগরে সুচেতার বাড়িতে যান। সেই সময় সুচেতা তাঁকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেন। সমরেশবাবুর ব্যারাকপুরে দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ভরা সংসার। তাই আপত্তি করেন তিনি। সমরেশবাবুর দাবি, সেই আপত্তি শুনে সুচেতা নিজের বছর চারেকের শিশুকন্যা দীপাঞ্জনাকে বালতির জলে ডুবিয়ে মারেন। সমরেশবাবু তাকে বাঁচাতে পারেননি বলেই জানিয়েছেন পুলিশের কাছে। তার পরে সুচেতা দরজা বন্ধ করে দেন। কিছু ক্ষণ পরে দরজার তলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখেন সমরেশবাবু। পুলিশের জেরায় তিনি জানান, দরজা ভেঙে ঢুকে দেখেন, সুচেতা নিজের গলার নলি কেটে আত্মহত্যা করেছেন! যদিও তার এই কথা শোনার পরে পুলিশমহলেই প্রশ্ন উঠেছে, কেউ কি আদৌ নিজের গলার নলি কেটে আত্মহত্যা করতে পারে?
সমরেশবাবুর আরও দাবি, এমন পরিস্থিতিতে প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে যান তিনি। উপায়ন্তর না দেখে সুচেতা এবং তার মেয়ের দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে চারটে ব্যাগে ভরেন— জানান তিনি। সমরেশবাবুর বয়ান অনুযায়ী, যে দু’টি ব্যাগের খোঁজে গভীর রাত পর্যন্ত গঙ্গায় ডুবুরি নামিয়ে খোঁজ চলে, তার একটিতে রয়েছে সুচেতার মুণ্ড, অন্যটিতে তাঁর মেয়ের দেহ। তবে রাত পর্যন্ত ব্যাগ দু’টির খোঁজ মেলেনি।
এই বয়ান শুনে তাজ্জব বনে যান ঘাঘু পুলিশকর্মীরাও। তবে তার নামে খুনের মামলাই দায়ের করা হয়। রাতেই শ্রীরামপুর থানার পুলিশ সমরেশবাবুকে নিয়ে দুর্গাপুরে যায়। তবে বিধাননগরে সুচেতাদেবীর বাড়ির কাছে প্রচুর লোকজন জমে যাওয়ায় কাজ না সেরেই দুর্গাপুরের থানায় ফিরতে হয় তাদের।
দেহাংশগুলি বোঝাই ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে সমরেশবাবুর বাড়ি ফেরাও বেশ রোমহর্ষক। তার এবং বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ওই ব্যাগ চারটি নিয়ে তিনি শনিবার সকালে বিধান এক্সপ্রেস ধরেন। সোজা এসে নামেন লিলুয়াতে। তার পর লোকাল ধরে আসেন শেওড়াফুলির তিন পয়সার ঘাটে। সেখান থেকে ভুটভুটিতে চেপে উল্টো দিকে গেলেই ব্যারাকপুর মণিরামপুর ঘাট। সেই পর্যন্ত এসে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরে হঠাৎ মত বদলান। মাঝরাস্তায় একটি মারুতি ভ্যান ভাড়া করে ফের ঘাটে এসে শেওড়াফুলি যাওয়ার ভুটভুটি ধরেন এবং জলে ব্যাগ ফেলার চেষ্টা করেন। কেন এমন করলেন তিনি, তার সদুত্তর এখনও পায়নি পুলিশ।
সুচেতা এবং সমরেশ, দু’জনের বাড়ির লোকই খবরের প্রাথমিক ধাক্কায় স্তম্ভিত। সুচেতার স্বামী, টাকি টাউন হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক শ্রুতিধর মুখোপাধ্যায় থাকেন বসিরহাটের কাছারিপাড়ায় এক ভাড়া বা়ড়িতে। সেখানে বসেই বারবার তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার মেয়েটাকে এ ভাবে মেরে ফেলল!’’ তার বক্তব্য, স্ত্রী আর মেয়ের খুনে অভিযুক্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ সরকারকে তিনি চেনেন না। তবে সুচেতার সঙ্গে যে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটা মেনে নিয়েছেন।
শ্রুতিধরবাবু জানান, সুচেতার সঙ্গে তার সম্বন্ধ করে বিয়ে হয় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। সুচেতাদেবী বসিরহাটে এসে সংসার পাতেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দুর্গাপুরে বাপের বাড়ি ফিরে যান তিনি। জুনে সেখানকারই একটি নার্সিং হোমে জন্মায় তাদের মেয়ে দীপাঞ্জনা। কিন্তু তার পর আর বসিরহাটে ফেরেননি সুচেতাদেবী। তার বাবা মারা যাওয়ার পরেও ফিরতে অস্বীকার করেন। ‘‘কবে ফিরবে, জানতে চাইলে ও বলতো— বসিরহাটে আর ফিরব না!’’
গত পুজোয় শেষ বার স্ত্রী-কন্যাকে দেখেন শ্রুতিধরবাবু। দুর্গাপুরে গিয়েছিলেন তিনি। একটা গাড়ি ভাড়া করে মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দিরও ঘোরেন তারা। ‘‘এর পর গত ডিসেম্বরে খবর দিয়েই ওখানে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি বাড়িতে তালা ঝুলছে,’’ বললেন তিনি। আর দুর্গাপুর যাননি শ্রুতিধরবাবু। ফোনে শেষ কথাও হয় সাত মাস আগে। তাঁর পাঠানো মানি অর্ডারের টাকা বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন সুচেতা। তাই টাকা পাঠানোও বন্ধ করে দেন।
দুর্গাপুরের বিধাননগর আবাসনে সুচেতাদেবীর প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সুচেতা বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেছিলেন। শ্রুতিধরবাবুর দাবি, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। বরং তিনি নিজেই দাম্পত্যের অধিকার পুনর্বহাল (রেস্টিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস) ধারার অধীনে মামলা করার কথা চিন্তা করছিলেন। ‘‘স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল ঠিকই। বাবার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ আর মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বসিরহাটে ফিরতে চাইছিল না সুচেতা। তা বলে বিচ্ছেদ হয়ে যায়নি,’’ বলেন তিনি।
অন্য দিকে, তার স্বামী এমন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, মানতে পারছেন না সমরেশবাবুর স্ত্রী উৎসাদেবী। ব্যারাকপুরে নিজের বাড়িতে বসে তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার স্বামী এমন করতেই পারেন না। তিনি একেবারেই সংসার-কেন্দ্রিক মানুষ।’’ তাঁদের দুই সন্তান। প্রতি শনি-রবিবার বাড়ি আসেন সমরেশবাবু— সব জানিয়ে উৎসাদেবী বলেন, ‘‘শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদও উনি ফোন করে জানতে চান, আমাদের রাতের খাওয়া হয়েছে কি না!’’ তাঁর দাবি, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
বিশ্বাস করতে পারছেন না সমরেশবাবুর সহকর্মীরাও। দুর্গাপুরের মামরাবাজারের যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তিনি, সেখানকার কর্মীরা জানালেন, সুচেতা চক্রবর্তী তাঁদের ব্যাঙ্কের গ্রাহক। ব্যাঙ্কে লকার রয়েছে। দিন চার-পাঁচ আগেও মেয়েকে নিয়ে ব্যাঙ্কে আসেন। তখন সমরেশবাবুকে দেখা যায় তাঁর সঙ্গে হেসে কথা বলতে। দীপাঞ্জনাকে চকোলেট দিতে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, তা কেউ আন্দাজ করেননি।
সহকর্মীরা আরও জানিয়েছেন, তিন বছর হল সমরেশবাবু দুর্গাপুরে এসেছেন। একা থাকেন ব্যাঙ্কেরই লাগোয়া আবাসনের দোতলায়। শুক্রবার তিনি ব্যাঙ্কে এলেও দুপুর ১২টা নাগাদ জ্বর এসেছে বলে বেরিয়ে যান। তাদের কথায়, হাসিখুশি আমুদে মানুষ সমরেশবাবু। সবার সঙ্গে মেশার সহজাত ক্ষমতা আছে। মহিলাদের সঙ্গে একটু বেশিই কথা বলেন।
সুচেতাদেবীর প্রতিবেশীরা অনেকে অবশ্য টিভিতে সমরেশবাবুর ছবি দেখার পর নিশ্চিত, এই ভদ্রলোক মাঝেমধ্যেই সুচেতার কাছে আসতেন। অটো বা গাড়ি থেকে তাঁদের একসঙ্গে নামতেও দেখেছেন, দাবি তাঁদের।
পুলিশও গোড়ায় বিশ্বাস করতে পারেনি, সমরেশবাবুর মতো ‘নিপাট ভদ্রলোক’ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, জেরার মুখে ততই ভেঙে পড়েছেন সমরেশবাবু। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘‘আমার চাকরি চলে যাবে!’’ ক্রমে পুলিশের ধারণা জন্মায়, তিনি সহানুভূতি আদায়ের জন্য এমন বলছেন। আসলে তিনি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিক পুরো ঘটনাটা ঘটিয়েছেন।
সূত্র: আনন্দবাজার
মন্তব্য চালু নেই