ভোলার মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা মানুষ

নদী মোগো সব কাইড়া নিছে। টাহা(টাকা) নাই, পয়ছা(পয়সা) নাই এখন কোনায়(কোথায়) আশ্রয়(নেবো) নিবো। ছেলে-মেয়েদের কি খাওয়াবো, কি পড়াবো, রাস্তায় ওপর কোনো রকমে পড়ে আছি।

কান্না জড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন নদী তীরের বাসিন্দা গৃহবধূ নাছিমা (৩০)। তিনি জানান, স্বামী-সন্তান নিয়ে অভাবের সংসার তাদের। কিন্তু নদী ভিটাহারা করে একেবারে পথে বসিয়েছে দিয়েছে, এখন আর কোনো কূল কিনারা নাই।

ভাঙা ঘর-দুয়ার নিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন আরেক গৃহবধূ বিলকিছ। নদী ভাঙনে একমাত্র সম্বল হারিয়ে এখন তার আশ্রয় খোলা আকাশের নিচে।

বিলকিছ জানায়, তার স্বামী আফছার আলী জেলে। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন কাটে তাদের। কিন্তু রাক্ষুসি মেঘনা মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই টুকুও কেড়ে নিয়েছে। এখন আর নতুন করে ঘর তোলার সামর্থ্য নাই তাদের। ভোলার মেঘনার ভয়াল ভাঙনে ভিটাহারা নাছিমা ও বিলকিছের মত শত শত পরিবার ঠিকানা হারিয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কোথায় আশ্রয় নিবেন তা বলতে পারছেন না তারা। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ঠিকানাহারা পরিবারগুলো যেন কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেননা।

ভোলা সদরের ইলিশা পয়েন্ট দিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো ৫ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। চড়ার মাথা থেকে পুরাতন ফেরিঘাট পর্যন্ত পুরো সড়ক ধসে গেছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হচ্ছেনা। ভাঙনের তীব্রতা বেশি থাকায় হমুকির মুখে পড়েছে জংশন বাজার, ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি মাছের ঘের, একটি পুলিশ ফাঁড়িসহ পাঁচটি ইউনিয়ন।

নদীর গতি পরিবর্তন ও বেশ কয়েকটি গোল সৃষ্টি হওয়ার ফলে এ ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। তারা বলছেন, ভাঙন রোধে নির্ধারিত সময়ে ব্যবস্থা নিলে এতো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে তাদের পড়তে হতো না।জানা যায়, পানির স্রোতের সঙ্গে বড় বড় পাড় নদীতে ধসে পড়ছে। জোয়ারের সময় একটু কম হলেও ভাটায় অতিরিক্ত ধস হচ্ছে। নদীর তীরের মানুষ ঘরভিটা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সময়ও পাচ্ছেননা।

একদিকে নদীর ভাঙন চলছে, অন্যদিকে তীরের মানুষগুলো তাদের ঘরের আসবাসপত্র সরিয়ে ফেলছেন। সহায় সম্বল হারা পরিবারগুলো নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।এদের মধ্যে নাজমা, হাসিনা, জরিনা ও রাজিয়া জানান, নিজেদের জমি বলতে যা ছিলো তা মেঘনা কেড়ে নিয়েছে। এখন নতুন করে আশ্রয় খুঁজছি। অন্য কোথাও জমি কেনার সামর্থ্য নেই। তাই টাকা-পয়সার অভাবে খোলা আকাশের নিচে কিংবা সড়কের পাশেই ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে দিন কাটাতে হবে। এতো দুর্দশায় থাকলেও সরকার তাদের কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।

ভাঙন কবলিত ইসমতআরা ও ইমন জানায়, এ পর্যন্ত সাতবার নদীতে তাদের ঘর ভেঙেছে, এতে বহুটাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এবার বাকিটুকুও সর্বনাশি মেঘনা কেড়ে নিয়েছে তাদের।আর নতুন ঘর বানানোর সামর্থ্য নেই। ঘরভিটা হারিয়ে পথে আশ্রয় নিয়েছেন জয়নাল ফরাজী, আ. বারেক শহিদ, আনিছ মাঝিসহ অসংখ্য পরিবার। সন্তানদের নিয়ে তারা নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন।

এদিকে, ভাঙন কবলিত দু’টি এলাকায় কাজ করছে ভোলা সেবা সংঘ ও অগ্রদুধ সংস্থা নামের দু’টি সেচ্চাসেবী সংগঠন। সংগঠনের পক্ষ থেকে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।ভোলা সেবা সংঘের চেয়ারম্যান মুন্সি ওবাদুল্লাহ রতন ও অগ্রদুধ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জানান, মেঘনার ভাঙনের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৬টি পরিবার ভিটা-হারা হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সাহায্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করবো।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হেকিম বলেন, ভাঙন রোধে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভাঙনের কারণ নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞ দলকে ভোলায় আসতে বলা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই