খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে আদালতে যা হলো
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা দুটি মামলায় তৃতীয় দিনের মতো মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী। আজ সোমবার পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদারের আদালতে এ শুনানি চলে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতের এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন বিএনপির চেয়ারপারসন। আদালতে প্রবেশ করে প্রথমে আইনজীবীর মাধ্যমে বসার অনুমতি চান খালেদা জিয়া। বিচারক অনুমতি দেওয়ার পর এজলাসের সামনে রাখা একটি হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেন খালেদা জিয়া। এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাদীকে জেরা শুরু করেন। বাদী হারুনুর রশীদকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল জিয়ার আদর্শকে ধারণ করার জন্য। মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও দুস্থদের সহায়তা করার জন্য। মামলার সময় আপনি দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতির আশায় আপনি এই মামলা দায়ের করেছেন। আপনি পদোন্নতি পেয়েছেন?’
এ প্রশ্নের জবাবে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি একা নই, আমার সঙ্গে ৩০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জমি কেনার সময় কোনো অর্থ আত্মসাৎ হয়নি। তবে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ট্রাস্ট গঠন করে এই পদের অপব্যবহার করেছেন।’
এ সময় বাদীকে আরো ২৩টি প্রশ্ন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী। প্রশ্ন এবং এর উত্তরগুলো আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
খন্দকার মাহবুব : রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ফান্ড থাকে তা কীভাবে পরিচালিত হয়, সে বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে?
সাক্ষী : দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।
খন্দকার মাহবুব : জাতীয়তাবাদী দলের টাকা কার স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়?
সাক্ষী : দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।
খন্দকার মাহবুব : জাতীয়তাবাদী দলের টাকা কার স্বাক্ষরে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে আপনি কোনো কিছু জব্দ করেছেন?
সাক্ষী : অনুসন্ধানকালে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি, কিন্তু জব্দ করিনি।
খন্দকার মাহবুব : তখন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কে ছিল?
সাক্ষী : মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া।
খন্দকার মাহবুব : রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির তখন কয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল?
সাক্ষী : আমার জানামতে সাতটি অ্যাকাউন্ট ছিল।
খন্দকার মাহবুব : কার স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যেত?
সাক্ষী : অনেকের স্বাক্ষরে উত্তোলন করা যেত। একেক সময় একেকজনের দায়িত্বে ছিল।
খন্দকার মাহবুব : রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয় তা জানেন?
সাক্ষী : ওই সময় ছিল কি না জানি না, তবে এখন দাখিল করতে হয়।
খন্দকার মাহবুব : এসব হিসাব কেন দেওয়া হয়?
সাক্ষী : যদি পার্টির আয়-ব্যয়ে গরমিল থাকে তাহলে জবাবদিহিতার জন্য।
খন্দকার মাহবুব : এ মামলা করাকালীন আপনার পদবি কী ছিল?
সাক্ষী : দুদকের সহকারী পরিচালক।
খন্দকার মাহবুব : বর্তমান সরকারের আমলে মামলা করলে বাদীর ভাগ্য পরিবর্তন হয়, শুনেছি আপনারও পদোন্নতি হয়েছে?
সাক্ষী : আমি একা নই, আমার সঙ্গে ৩০ জনের পদোন্নতি হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব : চ্যারিটেবল ট্রাস্টে কার কাছ থেকে দান নেওয়া যাবে আর কাছ থেকে নেওয়া যাবে না এমন কোনো বিধান আছে?
সাক্ষী : নিষেধাজ্ঞা নেই।
খন্দকার মাহবুব : আপনিও মুসলমান আমিও মুসলমান। কুরআন-হাদিসে উল্লেখ আছে দান করতে হয় গোপনে।
সাক্ষী : এটি একটি ধর্মীয় প্রশ্ন।
খন্দকার মাহবুব : এ আদালতে শুধু আপনি আর আমি ভালো মানুষ, প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক জবাব দেন।
এ সময় আদালতের ভেতরে থাকা অন্য আইনজীবীরা হেসে ওঠেন। এ সময় বিচারক বলেন, ‘মুসলমান আর ভালো মানুষ শুধু আপনারা দুজন নয় আরো আছে।’
খন্দকার মাহবুব এরপর আবার প্রশ্ন করেন : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে টাকা এসেছে কীভাবে, পে-অর্ডারের মাধ্যমে?
সাক্ষী জবাব দেন : চেকের মাধ্যমে।
খন্দকার মাহবুব : জমির মালিককেও পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয়েছে। জানেন কিছু?
সাক্ষী : বিজ্ঞ আদালতে চেকটি দাখিল করা হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব : এ মামলা দায়ের করার আগে প্রমোশনের প্রলোভন দেখিয়ে মামলা তৈরি করা হয়েছে, পরে আপনাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সাক্ষী : ইহা সত্য নয়। আমার সঙ্গে ৩০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জন্য কেনা জমি আপনি দেখেছেন?
সাক্ষী : জমির মূল্য দেখেছি?
খন্দকার মাহবুব : কত টাকা?
সাক্ষী : ছয় কোটি ৪৯ লাখ সাত হাজার টাকা এবং স্থাপনার মূল্য তিন লাখ টাকা। মোট ছয় কোটি ৫২ লাখ সাত হাজার টাকা।
খন্দকার মাহবুব : জায়গার মালিক কি টাকা পেয়েছেন?
সাক্ষী : জমির মূল্যসহ এক কোটি ২৪ লাখ টাকা বেশি পেয়েছেন।
খন্দকার মাহবুব : এই জমিতে কিছু অবৈধ দখলদার ছিল জানেন না?
সাক্ষী : আমার জানা নেই।
খন্দকার মাহবুব : আমাদের দেশে দুই ভাবে অবৈধ দখলদারদের বিতাড়িত করা হয়, লাঠি দিয়ে হটিয়ে অথবা কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
সাক্ষী : আমার অভিজ্ঞতা নেই।
খন্দকার মাহবুব : জমি কেনার সময় অবৈধ দখলদারদের এক কোটি ২৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে?
সাক্ষী : ইহা সত্য নয়।
খন্দকার মাহবুব : এটি ছিল ব্যক্তিগত ট্রাস্ট, রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সাক্ষী : প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এ কারণে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব : নিজের পদোন্নতি নিতে সরকারের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে জনসম্মুখে হেয় করার জন্য এবং সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য এ মামলা দায়ের করেছেন।
সাক্ষী : ইহা সত্য নহে।
জেরা শেষে আগামী ২৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচন থাকায় সময় চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। কিন্তু আদালত তা নাকচ করে ১০ আগস্ট মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের দিন নির্ধারণ করেন।
গত ২৩ জুলাই খালেদা জিয়ার আইনজীবীর করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার।
২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।
জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশীদ।
ওই মামলার অপর আসামিরা হলেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় আরো একটি মামলা করে দুদক।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে ৫ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন তিনি।
গত ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ নয়জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দুই মামলায় অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মন্তব্য চালু নেই