৭ বছর পর নৌকা-ধানের শীষের ফের লড়াই
৭বছর পর নৌকা-ধানের শীষের ফের লড়াই। দীর্ঘ সাত বছর পর দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে মুখোমুখি দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিচ্ছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। তবে লাইমলাইটে থাকবে দল দুটোর এ দুই প্রতীক।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর সারা দেশে ২৩৫টি পৌরসভায় একসঙ্গে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভোটাররাও ভোটদানের অপেক্ষায়। ফলে পৌর নির্বাচন হলেও জাতীয় নির্বাচনের মতোই ভোটের আমেজ বিরাজ করছে এখন। নির্বাচন কমিশনের ২২টি নিবন্ধিত দল দলীয় প্রতীক নিয়ে নেমেছে। জামায়াতসহ অন্য অনিবন্ধিত দলগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভিন্ন প্রতীকে ভোট করছে।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা-ধানের শীষ প্রতীকের ভোটযুদ্ধ হয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও তাতে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। ওই নির্বাচন বর্জন করে গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ আরও বেশ কয়েকটি দল। পৌরসভা নির্বাচনে ছোট ছোট দলগুলোও মাঠ চষে বেড়াচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ‘পৌর নির্বাচনের শুরুতেই এক অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) রিটার্নিং অফিসার না করলেই ভালো হতো। বিতর্ক থাকত না। এখন এক অবিশ্বাস থেকেই নির্বাচন কমিশনকে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আশার দিক হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দল নামে-বেনামে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ভোটাররাও অপেক্ষায়। সারা দেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে— জনগণ এটাই আশা করে। এখন নির্বিঘ্নে ভোটদানের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী ভূমিকা পালন করে— তা আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। দলের বাইরেও স্থানীয় প্রভাব— নির্বাচনে কাজ করবে। সর্বশেষ তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিএনপিও ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোটের দিন প্রথম প্রহরেই বর্জন করে। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও দেশে-বিদেশে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিএনপিকে ভোটে রাখতে নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। জনগণকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া-আসার নিশ্চয়তা দিতে হবে। নির্বাচনের কর্তাব্যক্তিদের নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পৌর নির্বাচন হলেও ভালো দিক হচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনে গেছে। তারা নিজেদের দাবি-দাওয়াগুলো তুলে ধরেছে। দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। এখন আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। মনোনয়নপত্র বাতিল হচ্ছে কার কার। নতুন করে বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীরা গ্রেফতার বা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কিনা। তবে মানুষ ভোট দেওয়ার অপেক্ষা করছে। উপরে শান্তিপূর্ণ হলেও ভোট সুষ্ঠু না হলে তাতে কোনো লাভ নেই। ফেনীর ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বিগত ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে আসন্ন পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে তার অবসান ঘটাতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে বিএনপিসহ সব দলকে এ নির্বাচনে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া নৌকা-ধানের শীষের নির্বাচনী লড়াইয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তি যাচাই করতে চান খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে পৌর নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে দিনভর দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার সকালেও ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে সারা দেশে ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের’ সঙ্গে কথা বলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাক, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, উপপ্রচার সম্পাদক অসীমকুমার উকিল, সদস্য এস এম কামাল হোসেন প্রমুখ।
এ ছাড়াও বিকালে পৃথক দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকেও একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে করণীয় নির্ধারণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চায় উত্সবমুখর পরিবেশে জনগণের রায় নিয়ে দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসুক। কিন্তু একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে কাল্পনিক অভিযোগ করে আসছে। বিএনপিকে আশ্বস্ত করতে চাই— অহেতুক যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, তাদের হয়রানি করার সুযোগ নেই।’
আওয়ামী লীগের পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে পৌরসভা নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় আমরা পৌর নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আমরা চাই গণতন্ত্র বিকশিত হোক।’
বিএনপি সূত্র জানায়, দল পুনর্গঠন ও আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ভোটযুদ্ধে নামছে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। লন্ডন থেকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ নিয়ে প্রতিদিনই নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এ নির্বাচনে লড়তে এখন ভোটের মাঠে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, আসন্ন পৌর নির্বাচনে হারলেও লাভ, জিতলেও লাভ। দলটি মনে করে, মোটামুটিভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ৮০ ভাগ পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হবেন। অন্যদিকে সরকার কারসাজি করে বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নিলেও গণমাধ্যমের সুবাদে দেশে-বিদেশে এ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠবে। এ নিয়ে আন্দোলনের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। ফলে পৌর নির্বাচনকেই আন্দোলনের হাতিয়ার করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিগত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যে কারণে দেশে-বিদেশে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। নির্বাচন কমিশনকে বলা হয় সরকারের এজেন্ট। এবার তাদের স্বচ্ছতা প্রমাণের পালা। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। এখন আমরা এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেখতে চাই, সরকার ও নির্বাচন কমিশন জনগণের কতটুকু আস্থা অর্জন করতে পারে।’
বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘চলমান সংকট উত্তরণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাই। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন সে পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’
মন্তব্য চালু নেই