৬ জুন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অর্ধডজন মেগাপ্রকল্পের দ্বার খুলতে পারে
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের ৫ মাসের মাথায় জাপান সফরের পর এবার চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক বন্ধন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আগামী ৬ জুন ৫ দিনের এ সফর হতে যাচ্ছে। সফরে বহুল আলোচিত মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দরহ অন্তত অর্ধডজন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বার উন্মোচিত হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন সফর চূড়ান্ত হওয়ার পর নিয়মিত বেইজিংয়ে সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চলছে। সফরের আদ্যোপান্ত নিয়ে মন্ত্রণালয় ঢাকায় চীনা দূতাবাস এবং বেইজিং পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে কথা বলছেন প্রায় প্রতিদিনই।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে সামনে রেখে বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, চীনের সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূলত ৬টি মেগা প্রকল্প নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে চীনের দেয়া অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়টিও উঠে আসছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কমকর্তা বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল জাপান সফরে বেশকিছু প্রকল্পে বিনিয়োগ নিশ্চয়তা পাওয়ার পর কোন কোন খাতে চীনের বিনিয়োগ হতে পারে তার একটি চূড়ান্ত রূপরেখাও ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।’
সূত্র বলছে, এসব মেগা প্রকল্প ছাড়াও বেজিংয়ের কাছে গত বছরের জানুয়ারিতে দেয়া ১৪ প্রকল্পের মধ্যে ১৩টির ব্যাপারে বিনিয়োগ সম্ভাবনার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সফরকালে কী কী বিষয় প্রাধান্য পাবে এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, ‘সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্র বন্দর, পদ্মা বহুমুখি সেতু (পিএমবি), যমুনা নদীর ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু রেল ব্রিজ, কর্ণফুলী টানেল এবং একই নদীর ওপর কালুরঘাট রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণ আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং বিজনেস ফেয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বেইজিং সফর করবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে এবং এর আগে মেগা প্রকল্পগুলোর চুক্তি সইয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার (বিসিআইএম) সমন্বয়ে গঠিত নতুন অর্থনৈতিক জোটকে এগিয়ে নেয়া, বাংলাদেশ চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, দুই দেশে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বর্তমানে চীনে ৪৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে। বিপরীতে চীন থেকে আমদানি হচ্ছে ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর পাশাপাশি ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে শুল্ক সুবিধা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়ানো এবং বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি পণ্য রপ্তানির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।’
এছাড়া চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও বিশেষ ছাড় দাবি থাকবে ঢাকার পক্ষ থেকে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনার মধ্য থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ইআরডির (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে পরিশোধের মেয়াদ ১০ থেকে ১৩ বছর, এছাড়াও আরো ৩ বছরের গ্রেসপিরিয়ড আছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর করার বিষয়ে নিয়ে চীনের সঙ্গে দরকষাকষি হতে পারে।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে ১৪টি মেগাপ্রকল্পের একটি তালিকা জমা দেয়া হয়। পরে চীন এসব প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মতি জানিয়ে ৫ বছর মেয়াদে পরিকল্পনা করার তাগিদ দেয়। তবে এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পে ৫ বছর মেয়াদি বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা প্রস্তুত বলে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এসব প্রকল্প ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে বাস্তবায়নের ব্যাপারেও চীন প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে চূড়ান্ত করতে চায় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ইআরডি থেকে বড় কিছু প্রকল্প চূড়ান্ত করে জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গা (পদ্মা) ব্যারেজ প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেস লাইন (ঢাকা-কুমিল্লা), বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশ দিয়ে নতুন একটি রেল সেতু (ডুয়েল গেজ), সোনাদিয়ার গভীর সমদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ চীনা প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার ব্যাপারে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফরে ‘চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির’ সঙ্গে এমওইউ (সমঝোতা স্বারক) সইয়ের বিষয়টি ঠিকঠাক হয়ে আছে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে চীনের সঙ্গে চারটি সামরিক চুক্তিতে সই করেছে সরকার।
চার দশক আগে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যেও সম্পর্ক তৈরি হয়।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে দুটি চীনা সাবমেরিন যুক্ত হবে।’ চীন থেকে আনা আবু বকর ও আলী হায়দার নামে দুটি নতুন ফ্রিগেট গত মার্চে নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী আগামী ৬-১০ জনু পর্যন্ত চীন সফর করবেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর শতাধিক সফরসঙ্গী থাকছে।
মন্তব্য চালু নেই