৪৩ বছর আগের এক যুদ্ধদিনের মর্মান্তিক ছবি এবং একজন ফটোগ্রাফার
১৯৭২ সালের ৮ই জুন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে তখন। সেদেশের টাই নিন প্রদেশের ট্রাং ব্যাং শহরের একটি হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বার্তা সংস্থা এপির ফটোসাংবাদিক নিক উট। এমন সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যরা বিমান থেকে নাপাম বোমা (এক ধরনের পেট্রোল বোমা) ফেলতে শুরু করলো।
হুড়োহুড়ির মধ্যে একটি দৃশ্যে চোখে আটকে গেলো নিকের। একটি নগ্ন ভিয়েতনামি কন্যাশিশু কাঁদতে কাঁদতে অন্যদের সাথে পালাচ্ছে। এক মুহুর্ত দেরি না করে হাতে থাকা কোডাক টাই-এক্স ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট দিয়ে ক্যামেরাবন্দী করলেন মুহুর্তটি। এখনো ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমার্থক হয়ে আছে ছবিটি। অনন্য এ ছবিটির জন্য পরে ফটোগ্রাফির সবচেয়ে সম্মানজনক খেতাব পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত হন নিক। ছবিটির নাম তিনি রেখেছিলেন ‘নাপাম গার্ল’।
ছবিটি তোলার ঠিক ৪৩ বছর পরে গত ৮ জুন সোমবার সেই ঐতিহাসিক ছবিটির স্মৃতিচারণ করতে ভিয়েতনামের ওই শহরে গিয়েছিলেন নিক। রাস্তায় মানুষদের দেখিয়ে দেখিয়ে বলছিলেন, ওদিকে তাকাও। ‘এ জায়গাটিকে পৃথিবী কখনো ভুলতে পারবে না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের নয় বছরের যে নগ্ন মেয়েটির ছবি বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করেছে, সেটি ঠিক এখানেই তোলা। আমি সেই কালের সাক্ষী।’ নিক জানান, বোমার আঘাতে এ মেয়েটির শরীরের অনেকখানি পুড়ে গিয়েছিলো। শিশুটির নাম ছিলো কিম পুক।
এপির ফটোগ্রাফার নিক
এই ৪৩ বছরে সবকিছুই বদলেছে। যুদ্ধদিন শেষে ফিরেছে শান্তি। বদলেছে ক্যামেরা নামক সেই আজব যন্ত্রটিও। সেবার ছবিটি তোলার সময় নিকের হাতে ছিলো পুরোনো আর বিশাল সাইজের এক ক্যামেরা। আর আজ (৮ জুন ‘১৫) নিকের কাছে আছে অত্যাধুনিক ক্যামেরা, মাত্র ৪ আউন্স ওজনের আইফোন, সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম, যেখানে ছবি পোষ্ট করা মাত্রই তা দেখতে পারে বিশ্ববাসী। এখন সবার হাতে আছে ’ডিজিটাল আই’।
বিশেষ এই একটি দিনের জন্য এপির ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটিতে ছবি আপলোড করার অনুমতি দেয়া হলো নিককে। এটা সেইসময়ের সাথে এখনকার পার্থক্য বোঝানের জন্য করা হয়েছে। তখন ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিনে এপির অফিসে গিয়ে ছবি জমা দিতে হতো, পত্রিকায় প্রকাশ করার আগে সেটিকে প্রিন্ট করতে হতো, আরো কত কী! আর এখন সামান্য একটি আঙ্গুলের ছোঁয়াতেই আপনার তোলা ছবি পৌঁছে যায় সমগ্র বিশ্বে।
যুদ্ধক্ষেত্রের ঠিক পাশেই একটি নারকেলের দোকানে কাজ করেন ২৪ বছর বয়সী নুইয়েন থি থান। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই
নিক তখন টগবগে তরুণ। ছবিটি তোলারও অনেক পরে তা প্রত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলো। এখনকার মত প্রায় সাথে সাথে ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো না। আর প্রকাশের সাথে সাথেই প্রায় অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে ভিয়েতনামে চালানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণঘাতি যুদ্ধকে এ ছবিটি আরো বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিলো।
একটি চলতি ভ্যানের উপর বসে যখন ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন নিক, তখনো তার গলায় ঝুলছে অত্যাধুনিক লাইকা ক্যামেরা, হাতে আইফোন ফাইভ। হাইওয়ে ধরে ধরে নিক যখন হো চি মিন সিটির দিকে যাচ্ছিলেন, যুদ্ধের এতবছর পরে এসে রাস্তার দু পাশের দৃশ্যপট আমুল বদলে গেছে। ভ্যানটি যখন একটি ব্রিজের উপর আসলে, চিৎকার করে উঠলেন নিক। এইতো, এটাই সে জায়গা, যেখানে ‘নাপামা গার্ল’ সৃষ্টি হয়েছিলো। গত কয়েকবছর ধরেই নিক মাঝে মাঝেই এ জায়গায় আসেন। অন্তত বছরে একবার। যুদ্ধের সময়ের সাথে এখনকার গ্রাম, প্রকৃতি এসবের মেলবন্ধন খোঁজেন তিনি।
এই সেই ব্যাক্তি, ১৯৭২ সালের ছবিতে যাকে কিম পুকের পাশে দৌড়াতে দেখা গিয়েছিলো
ট্রাং ব্যাং শহরের খুঁজতে খুঁতে সেই নগ্ন শিশুকন্যা কিম পুকের দুজন আত্নীয়েরও সন্ধান পেয়ে যান নিক। তারপর তাদেরকে সাথে নিয়ে ছবি তোলার স্থানে গেলেন। সে সময়টির বর্ণনা খুবই আকর্ষণীয়। নিক বলছিলেন, ‘আমি মানুষের হাতে ধরা আমার তোলা ছবিটির ছবিই তুলছি, আর মানুষজন আমার ছবি তুলছে!’
নিক সেদিন ইনস্টাগ্রামে ট্রাং ব্যাং শহরের ছয়টি ছবি পোষ্ট করেছেন। এরমধ্যে এমন একজনের ছবি আছে, যাকে ১৯৭২ সালের ছবিতে কিম পুকের ঠিক পাশেই দৌঁড়াতে দেখা গিয়েছিলো। তার নাম হো ভ্যান বন (৫৪)। এখন তিনি শহরের রাস্তার পাশে একটি দোকান চালান। তাৎক্ষণিক ছবি শেয়ারিং ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রভাবশালী হতে পারে, যখন আপনার আশেপাশে খারাপ জিনিস ঘটতে থাকবে; বলছিলেন তিনি।
অ্যাঙ্গুইন থাই ডাম (৫৮), কিম পুকের ভাইয়ের বউ। এ নারী কিম পুকের ভাইকে বিয়ে করেছেন, ওই ছবিতে যাকে বামপাশে দেখা যাচ্ছে। বোমা হামলায় কিম পুকের ভাইয়ের এক চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
নাপাম গার্ল কিম পুকের এখন কি অবস্থা? যতদূর জানা যাচ্ছে, কিম পুকের জন্ম ১৯৬৩ সালের ২ এপ্রিল। সে হিসেবে এখন তার বয়স ৫২। তিনি এখন কানাডার নাগরিক। পড়াশোনা করেছেন কিউবার ইউনিভার্সিটি অব হাভানায়, মেডিসিনে। তাঁর দুটো সন্তান অছে। এছাড়া ইউনেস্কো গুডউইল অ্যাম্বাসেডর নামের একটি বইয়ের লেখকও তিনি। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কিম পুক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা অতীতকে মুছে ফেলতে বা পরিবর্তন করতে পারবো না। বরং অতীত থেকে কিভাবে শিক্ষা নেয়া যায়, তা নিয়েই ভাবতে হবে।
কিম পুক এখন
১৯৬৫ সালে এই ভিয়েতনাম যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলো নিকের ছোট ভাই, যিনি নিজেও এপির ফটোগ্রাফার ছিলো। সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগে থেকেই এপির ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন নিক। এ কারণে তাকে অনেকে এপির লাইফটাইম ফটোগ্রাফারও বলে থাকেন।
মন্তব্য চালু নেই