৩ বছরে নিখোঁজ সাড়ে ৩ হাজার ভিকটিম || থাইল্যান্ড জঙ্গলের টর্চার সেল মালেশিয়াগামীর মৃত্যুপুরী

কক্সবাজারের উখিয়ার উপকূলীয় এলাকার ১৩টি পয়েন্ট ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র এবার অতিসঙ্গোপনে মানবপাচারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার কারণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। এমতাবস্থায়ও অনিশ্চিত সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের তৈরি করা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে টর্চার সেল এখন মালয়েশিয়াগামীদের মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। গত ৩ বছরে সাগর পথে প্রায় ৫০ হাজার লোকজন মালয়েশিয়া পাচারের নামে উপকূল ছেড়েছে। এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজারেরও অধিক মালয়েশিয়াগামী। পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে দালালসহ প্রায় ৫শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করেছে।

উখিয়ার উপকূলীয় এলাকা মনখালী, ছেপটখালী, চোয়াংখালী, মাদারবনিয়া, মোঃ শফিরবিল, পাটুয়ার টেক, রূপপতি, নিদানিয়া, ইনানী, নিদানিয়া, রেজুরকুল, সোনাইছড়ি ও মানবপাচারের এয়ারপোর্ট হিসাবে খ্যাত বাদামতলীর ঘাট দীর্ঘদিন থেকে মানবপাচারের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসলেও গত ৫ মাস ধরে পুলিশ-বিজিবি’র ধারাবাহিক অভিযানের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে মানবপাচারকারীরা। এমতাবস্থায় ইনানী, সোনাইছড়ি ও জুম্মাপাড়ার বিভিন্ন গভীর অরণ্যে মালয়েশিয়াগামীদের জড়ো করে সুযোগ বুঝে পাচারকারীরা নৌকায় তুলে দেয়। এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীরা আগের মতো জমজমাট ভাবে মানবপাচার না হলেও পাচারের ধারাবাহিকতা কমেনি।

সোনাইছড়ি গ্রাম ঘুরে একাধিক পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের গ্রাম থেকে দুইশতাধিক লোকজন মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ যাত্রীর খোঁজখবর পাচ্ছে না দীর্ঘদিন থেকে। মালয়েশিয়া দালালের নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা হলদিয়া পালং ইউনিয়নের মরিচ্যা গ্রামের ১৭ বছরের যুবক শফিউল আলম জানান, তাকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একটি বন্দিশালায় প্রায় একমাস ধরে মুক্তিপনের জন্য আটকিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে তার পিতা বসতভিটা বন্ধক রেখে দালালদের চাহিদামত টাকা পরিশোধ করলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। শারীরিক ভাবে মারাতœক অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করার অক্ষমতা প্রকাশ করায় স্থানীয় অন্যান্য সহপাঠীদের সহযোগীতায় দীর্ঘ ৩ মাস পর সে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। শফিউল আলম আরো জানায়, তার মতো শত শত যাত্রী দালালদের মৃত্যুপুরীতে আটক রয়েছে। দালালের নির্যাতনে এসব যাত্রীর আকাশ ফাঁটা আতর্œনাদেও কোন কাজ হচ্ছে না। একই ভাবে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসা চোয়াংখালী গ্রামের আলতাজ মিয়ার ছেলে শমশের আলম(১৮) জানায়, অসচ্ছল পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে তাকে প্রায় দেড় মাস নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এভাবে মালয়েশিয়াগামীদের জড়িত পরিবারের অনেকেই বললেন, হতদরিদ্রতার কারণে তারা মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে।

উখিয়া-টেকনাফ উপকূলীয় এলাকায় মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করছে এমন একটি এনজিও সংস্থা হেলপ্ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক এম এ কাশেম জানান, মানবপাচার নিয়ে টাকা পয়সা লেনদেন ও নিখোঁজযাত্রীর ঘটনা নিয়ে তাদের কাছে প্রায় ৫শতাধিক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ বছরে উখিয়া-টেকনাফের উপকূল দিয়ে স্থানীয়, রোহিঙ্গা নাগরিক ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা প্রায় ৫০ হাজার লোকজন সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার হয়েছে। তৎমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার যাত্রীর পরিবার পরিজন এখনো খোজঁখবর পায়নি। পুলিশ-বিজিবি-কোস্টগার্ড বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে দালাল সহ ৫শতাধিক মালয়েশিয়া যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। মালয়েশিয়া পাচার প্রতিরোধে উপকূলের রেজু এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার নুরুল ইসলাম জানান, গত ৪ মাসে ১৫ জন মালয়েশিয়া যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে বিজিবি’র ল্যান্স নায়েক হাবিব মৃত্যু বরণ করেছে। তিনি বলেন, দালালচক্র তাদের নিরাপত্তার জন্য গভীর জঙ্গলে মালয়েশিয়া যাত্রীদের পাচারের জন্য জড়ো করে রাখার কারণে পুলিশ-বিজিবিও অনেক সময় দূর্গম এলাকা বিধায় অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে।

উপকূলের ইনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আলা উদ্দিন জানান, গত ৫ মাসে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬০ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। এসময় ২০ জন দালালকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রুজু করা হয়েছে। এব্যাপারে কক্সবাজার পুলিশ সুপার শ্যামল কান্তি নাথ জানান, উখিয়া থানা পুলিশ গত এক বছরে উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে সহস্রাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। এসময় ৩৫জন দালালকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রুজু করেছে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানের ফলে সাগরপথে মানবপাচার আগের তুলনায় কমেছে। কক্সবাজার ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক লে.কর্ণেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, গত ৬ মাসে বিজিবি সদস্যরা উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭৮ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। এসময় ৩৫জন দালালকে আটক করে থানায় সোপর্দ্দ করে তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে ৩০টি মামলা রুজু করা হয়েছে। এসময় আরো ২৪ জন দালাল পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা রুজু করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই