২১শে ফেব্রুয়ারির চেতনা ও এ প্রজন্মের কিছু কর্মকান্ড
যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, সেই ১৯৮৮ – ১৯৯২ দিককার কথা। আমাদের বিদ্যালয়টি ছিল অন্য গ্রামে। নাম ছিল ‘কয়লা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’। আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে। আমরা কখনো ধূলা-কাঁদা মাখা রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে বিদ্যালয়ে যেতাম। আবার কখনো কম দূরত্বের জন্য মানুষের বাড়ীর উঠান, ধানক্ষেতের আইল দিয়ে যেতাম। তখনকার দিনে উৎসব বলতে ২ ঈদ, দূর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এগুলোই বুঝতাম। আর মাঝে মাঝে উপলক্ষ হয়ে উঠত কারো বিয়ে বা ভোট।
তবে একটা দিনে দেখতাম বিদ্যালয়ের পাশের ‘কয়লা প্রগতি সংঘ’ এর ছেলেরা কাঠ, কলাগাছ দিয়ে শদীদ মিনার বানাত। তাতে আবার ফুল দিয়ে ভরিয়ে দিত। দিনটা ঠিক উৎসব মনে হত না, তবে একটা টানে ঠিকই ছুটে যেতাম সেটা দেখতে। ঐ ক্লাবের সামনে এমন করে শহীদ মিনার বানানো ও তাতে ফুল দেয়া, চারিদিকে বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে আবার জায়গাটা ঘিরে দেয়া যেন কোন মানুষ বা প্রানী ইচ্ছে করলেই সেটি কোনভাবে নষ্ট না করতে পারে। ২০ ফেব্রুয়ারি সবাই খেঁটে খুঁটে শহীদ মিনার বানাত, ২১ শে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে সেখানে ফুলও দিত। ফুল না শুকানো পর্যন্ত সেটি সেখানেই থাকত।
এর দেখাদেখি আমার উদ্যোগে আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমিও কয়েক বছর আমাদের বাড়ীর উঠানে বাঁশের চটা ও পাঠকাঠি দিয়ে এমন শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম। নিজের বাড়ীতে লাগানো গাঁদা ফুল, জবা ফুল ও অন্যদের বাড়ী থেকে কিছু ফুল এনে সে শহীদ মিনার আবার সাজিয়েও রাখতাম। তখনকার দিনে গ্রাম তো দূরে থাক, শহরেও ফুল কিনতে পাওয়া যেত না।
২০০১ সালে ঢাকায় এসে ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২ টা ১ মিনিটে গিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সে কি মানুষ। পায়ের নীচে দেখি শুধু মানুষের জুতো আর জুতো। পা থেকে জুতো খুলে গেলে সেটা তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অনেকেই দেখি মানুষের চাপ সহ্য করতে না পেরে জগন্নাথ হলের পাঁচিলের কাঁটা তার ধরে ঝুলছে। সেদিন আমরা প্রত্যেকেই একটা করে ফুল দিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে সেবার মাইকে ঘোষনা দিচ্ছিলেন সম্ভবত আসাদুজ্জামান নূর। এত সহস্র মানুষের ভীড়ে চ্যপ্টা হয়ে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সেদিন কিন্তু আমরা ভাবিনি আমাদের অ আ ক খ লেখা পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরে যেতে হবে। সেদিন এটাও মনে হয়নি ক্যামেরায় ছবি ধরে রাখতে হবে। মোবাইল ফোন ও সহজলভ্য ছিল না, প্রযুক্তিও ছিল পিছিয়ে। বর্তমানের মত ‘সেলফি’ নামক মানসিক রোগও মানুষের ছিল না।
আপনি মনে করে দেখুন আপনার পাশের কোন গ্রামের বিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়ে এমন কাঠের, চটার শহীদ মিনার তৈরি হত। এখনো হয় বাংলাদেশের সবখানে। সেখানেও মানুষ সারিবদ্ধভাবে শ্রদ্ধা জানায় ৫২ এর ভাষা শদীদদের প্রতি। সেখানে থাকে আবেগ, থাকে এক গভীর ভালবাসা সেই মানুষগুলোর জন্য যারা আমার মুখের ভাষাকে রক্ষার জন্য নিজের প্রান দিয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু ব্যাবসায়ী এই ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনিটিকেও বাণিজ্যের উপলক্ষ বানিয়েছে। বিশ্বাস করুন গতকাল সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ১ ইঞ্চিও জায়গা খালি ছিল না একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে জামা কেনার ক্রেতার ভীড়ে। এই ফাল্গুনে ব্যাবসায়ীরা মানুষের আবেগ কে পূঁজি করে ৩ টি দিবস কে ব্যাবসার উপলক্ষ বানিয়েছে। ১ লা ফাল্গুন, ১২ ফেব্রুয়ারি ও ২১ ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশেষ পোশাক পরাতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু আপনার বাসার সবাই জানে তো ২১ ফেব্রুয়ারি কেন, ঐ দিন কি ঘটেছিল ? বাসার ছোট্ট বাবুগুলো বাংলার আগে হিন্দি শিখছে না তো টিভি’র দৌরাত্বে ? মনে আছে গতবছর এই দিনে সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা ফ্যাশান শো এর আয়োজন করেছিল ?
‘কুল’ ‘ডুড’ প্রজন্ম ২১ শে ফেব্রুয়ারির সঠিক চেতনা জানে ? ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শেকড়। এই শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশের কোন প্রজন্ম টিকে থাকতে পারবে না। রুগ্ন হয়ে বিদেশীদের অনুগ্রহে বাঁচতে হবে। কিন্তু ‘কুল’ প্রজন্ম সেটার প্রমান দেখাতে পারে না। এখনকার কোন কাজের প্রধান উদ্দেশ্যই থেকে ফেসবুকে নিজের ছবি দেখানো। এই লেখার সঙ্গে কিছু ছবি দেয়া হল যেখানে দেখবেন এই আবালগুলো শুধুমাত্র ফেসবুকে ছবি দেয়ার জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারি তে কি অংগ ভংগি করে ছবি তুলেছে। প্রজন্মের অন্যদেরই উচিৎ এই সমস্ত আবালদের পথে নিয়ে আসা এবং আমাদের শিকড় সম্পর্কে তাদের জানানো। এর পরও কাজ না হলে তাদেরকে প্রতিরোধ করা।
অন্যদিকে এই ‘কুল’ ‘ডুড’ প্রজন্মের বাইরে এক ছোট্ট শিশু আত্মহত্যা করেছে এই ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ভালবেসে। ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বাড়ির পাশের বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে আঁখি। সেই অপরাধে গালিগালাজ করে বাগানমালিক। আর অবুঝ স্কুলছাত্রী আঁখি সেই অভিমানে আত্মহত্যা করে। কোন আত্মহত্যাই আমাদের কাম্য নয়। তবে শিশুটি শহীদদের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই কিন্তু এত ব্যাকুল হয়েছিল। প্রকৃত ভালবাসা কিন্তু এমনই, যেখানে কোন প্রদর্শনীর ব্যাপার থাকবে না, থাকবে না ফেসবুকে ছবি দেয়ার উদ্দেশ্য, সেলফি নামক মানসিক রোগ যেখানে থাকবে অনুপস্থিত।
২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের অর্জনের দিন। জীবনের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি মাতৃভাষার অধিকার। এখন যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি একটি স্নিগ্ধ, শালীন, শান্ত দিন। যে দিনটিতে আমরা শুধু ভালবাসা দিব শদীদদের প্রতি, যে দিনে আমরা প্রতিজ্ঞ করব মাতৃভাষা রক্ষার, মাতৃভাষার প্রসার ও দেশপ্রেমের শপথ নিব। এ দিনে ‘কুল’ ‘ডুড’ প্রজন্মের এমন আহাম্মকি আচরন অগ্রহনযোগ্য। দুঃখের বিষয় হল এই আহাম্মক আবালদের পরিমান বাড়ছে দিন দিন। এস.এম সাইফুর রহমান-এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া
মন্তব্য চালু নেই