হেফাজত-জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করছে আ’লীগ
পরিবর্তনটা হয়েছে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশে বসে হয়তো অনেকে খেয়াল করেননি। তবে লন্ডনের দ্যা ইকোনমিস্টের চোখ এড়ায়নি। আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। তৈরি হয়েছে নতুন সমীকরণ। যা বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের রাজনীতিতে এক অনন্য ঘটনা।
ইসলামপন্থিদের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব কমছে আওয়ামী লীগের। বিশেষকরে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মসনদের যোগাযোগের বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। একাধিক ইস্যুতে সরকারের সর্বশেষ অবস্থানের প্রশংসা করেছে হেফাজত। সংগঠনটির আমীর আল্লামা আহমদ শফিও নির্বিঘ্নে হেলিকপ্টারযোগে ছুটছেন জেলা থেকে জেলায়।
অন্যদিকে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দৃশ্যত ২০দলীয় জোটে থেকেও নেই জামায়াত। অন্তত বছরখানেক ধরে প্রকাশ্যে জোটের কোনো কর্মসূচিতে যোগ দেননি জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি। পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিটি নির্বাচনেই জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে বিএনপি। জামায়াত ও বিএনপির দিকে পা বাড়ায়নি।
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্ভবের পর নতুন একটি বাঁকে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি। শুরুতে ক্ষমতাসীন সব মহলেরই সমর্থন লাভ করে এই মঞ্চ। এই মঞ্চের পাল্টা শক্তি হিসেবেই দৃশ্যপটে আসে হেফাজতে ইসলাম। ৫ই মে কি ঘটেছিল তা এখনও পুরোপুরি জানা যায় না। তবে হেফাজতের সঙ্গে একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরির উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন মহল।
বিশেষকরে বিএনপি থেকে হেফাজতকে বিচ্ছিন্ন করার তৎপরতা চলে জোরেশোরে। একজন উপদেষ্টা পুরো বিষয়টি তদারকি করেন। প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি মহলও হেফাজত হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ বাড়ায়। বেশকিছু সুযোগ-সুবিধাও পায় হেফাজত। সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসে আস্তে আস্তে। সম্প্রতি হেফাজতের একটি অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য যোগ দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ব্লগারসহ বিশেষ ধরনের কিছু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ধর্মের বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর কিছু প্রচারণাও চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরইমধ্যে এসবের বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।
অন্যদিকে, এসব হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখা হচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে, নানা সতর্কবার্তা। সরকার এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও দৃশ্যত আন্তর্জাতিক দুনিয়া তা বিশ্বাস করছে না। তারা ইঙ্গিত করছে চরমপন্থি গ্রুপগুলোর দিকে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষকরে ভোটের রাজনীতিতে তা সবসময়ই প্রভাব ফেলে। অতীতে এ কার্ড বেশিরভাগ সময়ই খালেদা জিয়ার হাতে ছিল। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। ওদিকে, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে বিশেষকরে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আহ্বান এসেছে ইমরান এইচ সরকারকে বর্জনের।
লন্ডনের দ্যা ইকোনমিস্ট লিখেছে, শেখ হাসিনা বলেছেন, আপত্তিকর মতামত প্রকাশ করেন এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সংঘটিত ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’র কোনো দায় তার সরকার গ্রহণ করবে না। ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান হেফাজতে ইসলামীর সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। কট্টরপন্থি ইসলামিক এ দলটি প্রধানমন্ত্রীর দলের সমালোচনা করতো।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্রের দুর্বল প্রতিক্রিয়ার কারণেই হত্যাকাণ্ডগুলো গতি পাচ্ছে। ব্রাসেলসভিত্তিক এনজিও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস্ গ্রুপ বাংলাদেশের ‘ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবিত ও অকার্যকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। সরকারের এই প্রতিক্রিয়ার শেকড় বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে প্রোথিত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ে তোলে। কিন্তু কয়েকটি অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ক্ষমতায় কয়েক দফা সামরিক শাসকদের অধিষ্ঠিত করে, যা দেশে ইসলামের সমর্থন বিস্তৃতিতে সহায়ক হয়। সামরিক শাসকদের একজন ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। পরের বেসামরিক সরকারগুলোও নিজেদের বৈধতাকে ধরে রাখতে গিয়ে ইসলামের ব্যবহারকে অব্যাহত রাখেন।
পর্যাপ্ত জনসমর্থন না পাওয়া (২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ) শেখ হাসিনা ধর্মীয় রক্ষণশীলদের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ছেন। মার্চ মাসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট দুই মিনিটে খারিজ করে দেয় একটি আদালত। বিরোধী দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আংশিকভাবে উল্টোপথে ধাবিত হচ্ছে। তারা ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।
তাদের প্রধান ইসলামিক মিত্রদল জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের কারণে দলটির নেতাদের ফাঁসির বিরুদ্ধে এখন আর প্রতিবাদ জানায় না বিএনপি। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রীয়াজ বলেন, ‘একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের মৃত্যুগাঁথা এখনই লেখাটা হয়তো বেশি আগেভাগেই হয়ে যাবে।’ তবে, একই কথা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে বলা যায় না।
ভারতের ইকোনমিক টাইমস লিখেছে, বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নৈতিক বৈধতা হারিয়ে সরকার ক্রমশ শক্তি ও ইসলামপন্থিদের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করেছে। হত্যাকাণ্ডে সরকারি প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হয়েছে। সরকারিভাবে নিন্দা জানানোর রীতি উঠে গেছে। এসব ঘটনায় গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াকে করা হয়েছে সংযমী। বাংলাদেশে রাজনীতিতে ও সরকারি ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা একটি অনিষ্পন্ন ইস্যু।
অভিযোগ আছে, গণতন্ত্রের স্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। সহিংস উগ্রপন্থি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ইসলামী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সমঝোতার কথা শোনা যায়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সদস্য বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশে আল কায়েদা ও আইসিস যে সক্রিয় এবং তারা এখানে তাদের সদস্য সংগ্রহ অভিযান বৃদ্ধি করেছে সে বিষয়ে ক্রমশ তথ্যপ্রমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ সরকারের চোখ বন্ধ করে রাখা তাদের জন্য যেমন বিপদের তেমনি তা ভারতের জন্যও বিপদের। অন্যদিকে, ভারতেরই আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ‘যুক্তি-বুদ্ধির উপর আক্রমণ ঠেকাইবার উপায় বা শক্তি আমাদের নাই, তাই নাগরিকরাই যুক্তি-বুদ্ধি সামলাইয়া নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন’ সর্বত্র প্রকাশিত এই প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্যায়েরও অনেক বেশি। ইহা সর্বনাশা।
গত কয়েক বৎসরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নানা ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা দেখাইয়াছে, বিরোধীহীন সংসদে তাহা দেখাইবার পরিস্থিতিও রহিয়াছে। অজুহাত দর্শাইবার জায়গা নাই। সহনশীল ইসলামের ধারাটি বাংলাদেশ হইতে চিরতরে মুছিয়া দিবার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার হইতে না চাইলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-অন্বিত দলটিকে নড়িয়া বসিতে হইবে। গত্যন্তর নেই।
ওদিকে, বাংলাদেশের অনেক পর্যবেক্ষক মার্কিন নির্বাচনের দিকেও দৃষ্টি রাখছেন। বিশেষকরে হিলারি ক্লিনটনের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি জোটে সেদিকেই বাংলাদেশিদের দৃষ্টি বেশি। যদিও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। ওখানকার জামায়াতের প্রচারণাও অনেকটা তাই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের দিকেও দৃষ্টি রাখছেন অনেক পর্যবেক্ষক। আগামী জুনে তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে। দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও ৭ ও ৮ই জুন এ সফর হতে পারে। সফরকালে সিনেটেও বক্তব্য রাখবেন নরেন্দ্র মোদি। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সফরে দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রের প্রশ্নটি মুখ্য আলোচ্য বিষয় হতে পারে। সে যাই হোক আপাত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণে বড়ধরনের পরিবর্তনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চিরায়ত শত্রু-মিত্রের হিসাব। (মানবজমীন)
মন্তব্য চালু নেই