হুনায়েনের যুদ্ধে মহানবী (সা.)

মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী এক জায়গার নাম হুনায়েন। মক্কা বিজিত হলে আরবের গোত্রগুলো স্বেচ্ছায় ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়ল। কিন্তু হাওয়াযিন ও সক্কিফ গোত্রদ্বয় বিচলিত হয়ে গেল। তারা ইসলামকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। হাওয়াযিন ও সক্কিফ গোত্রদ্বয় তীরনিক্ষেপণে ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। মক্কা বিজয়ের পর তাদের বদ্ধমূল ধারণা হলো, এখন আক্রমণ ত্বরান্বিত না করলে কোনো শক্তিই আর ইসলামকে পরাভূত করতে পারবে না। সে মতে ইসলামকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করার জন্য তারা সম্মিলিত হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করল। বিশাল বাহিনী নিয়ে তারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে হুনায়েন নামক স্নানে জমায়েত হলো।

অষ্টম হিজরির শাওয়াল মাসে তথা ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মহানবী (সা.) হুনায়েনের দিকে অগ্রসর হন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এই বিশাল বাহিনী দৃষ্টে একটু আত্মশ্লাঘার শিকার হন। ফলে তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আজ আমাদের বিরুদ্ধে আর কে জয়লাভ করতে পারে। আল্লাহর দরবারে তাদের এই আত্মশ্লাঘা অপছন্দনীয় হয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে :

‘আর বিশেষ করে হুনায়েনের (যুদ্ধের) দিনের কথা (স্মরণ কর) যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্যের জন্য গর্বিত ছিলে, কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং পৃথিবী বিস্তৃত সত্ত্বেও তোমাদের ওপর সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিলে। এরপর আল্লাহ তার রাসূলের ওপর ও মুমিনদের ওপর ‘সকিনা’ তথা প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং এমন এক সেনাদল প্রেরণ করলেন যা তোমরা দেখনি। আর কাফিরদের শাস্তি দিলেন। আর এটাই কাফিরদের শাস্তি’। (সূরা তওবাহ)

মুসলমানেরা যুদ্ধের প্রথম দিকে জিতেছিল এবং লোকজন যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সুযোগ বুঝে এ সময় শত্রুপক্ষের তীরন্দাজরা মুষলধারে তীর বর্ষণ শুরু করে। ফলে মুসলমানদের সেনাসারির শৃঙ্খলা ও বিন্যাস ভেঙে পড়ে,তাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। (বুখারি)

হযরত আবু কাতাদাহ (রা.) যিনি এই যুদ্ধে শরিক ছিলেন, বলেন- যখন লোকেরা পালাচ্ছিল তখন আমি দেখতে পেলাম, এক কাফির একজন মুসলমানের বুকের ওপর চড়ে বসেছে। আমি পেছন থেকে তার কাঁধের ওপর তলোয়ারের আঘাত হানলাম যা তার লৌহবর্ম কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। সে ফিরে আমাকে এমন জোরে চেপে ধরল যে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু তার আঘাত গুরুতর ছিল বিধায় ক্রমেই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ল এবং এক সময় নীরব ও নিথর হয়ে পড়ে গেল। ইতোমধ্যে আমি হযরত ওমর (রা.) কে দেখতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মুসলমানদের অবস্তা’কী? তিনি বললেন, আল্লাহর ফয়সালা এটাই ছিল। (বুখারি)

বাহ্যিক এই পরাজয়ের বিভিন্ন কারণ ছিল। অগ্রবর্তী সেনাদলের সেনানায়ক ছিলেন হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.)। এই দলের বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন মক্কার সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নওমুসলিম তরুণ যারা তারুণ্যের অহমিকায় তেমন করে অস্ত্রসজ্জিত না হয়েই যুদ্ধের ময়দানে এসেছিলেন। তাদের সংখ্যা ছিল দুই হাজার। এমন কিছু সদস্যও ছিলেন যারা তখনো ইসলাম কবুল করেননি। তদুপরি হাওয়াযিন গোত্র তীরনিপেক্ষপণে গোটা আরবেই ছিল মশহুর। এ ক্ষেত্রে তারা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের নিক্ষিপ্ত তীর সাধারণত ব্যর্থ হতো না। অধিকন্তু তারা আগেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছে সুবিধাজনক জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছিল এবং তীরন্দাজরা পাহাড়ের ঘাঁটি, গুহা ও গিরিপথে নিজেদের মোতায়েন করেছিল। (সীরাতুন্নবী)

বৃষ্টির মতো তীর বর্ষিত হচ্ছিল। ১২ হাজার সৈন্য হাওয়া হয়ে গেল। কেবল একজন বরকতময় সত্তা পাহাড়ের মতো অনড় ও অটল রইলেন যিনি একাই ছিলেন এক বিরাট সেনাদল, একটি দেশ, একটি মহাদেশ, একটি জগৎ বরং সম্মানিত সমগ্র সৃষ্টিকুল। (তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

নবী করীম (সা.) তার ডান দিকে তাকালেন এবং ডাক দিলেন, ‘হে আনসার সমপ্রদায়।’ ডাক দিতেই উত্তর ভেসে এল, আমরা হাজির। এরপর তিনি বাম দিকে ঘুরে ডাক দিলেন। একই উত্তর ভেসে এলো। অতঃপর তিনি সওয়ারি থেকে নেমে এলেন এবং জালালে নবুওয়তের স্বরে বললেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (বুখারি)

বুখারি শরিফের অপর রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, তাঁর জবান মোবারকে তখন নিম্নোক্ত কবিতার চরণটি উচ্চারিত হচ্ছিল :

‘আমি নবী, মিথ্যা নয় তা;

আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর,

মিথা নয় তা-ও।’

হযরত আব্বাস (রা.) ছিলেন দরাজকণ্ঠের অধিকারী। নবী করীম (সা.) তাঁকে মুহাজির ও আনসারদের ডাক দেয়ার জন্য বললেন। তিনি ডাক দিলেন, আনসার সমপ্রদায়! যারা বায়াতে দিরওয়ানে শরিক ছিল! প্রভাবমণ্ডিত আওয়াজ কানে পড়তেই সমগ্র ফৌজ হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়াল। যাঁদের ঘোড়া দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও ভয়াবহ যুদ্ধের দরুন তাৎক্ষণিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা শরীরে পরিহিত লৌহবর্ম খুলে ছুড়ে ফেলেন এবং ঘোড়ার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েন। ফলে হঠাৎ করেই যেন যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রের গোটা চিত্রই পাল্টে যায়। কাফিররা পালাতে থাকে আর যারা পালাতে পারেনি তারা বন্দী হয়। সক্কিফ গোত্রের একটি শাখা বনু মালিক দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। তাদের ৭০ জন মারা যায়। তাদের পতাকাবাহী উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মারা যেতেই তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে।



মন্তব্য চালু নেই