হাসপাতাল থেকে রোগীর মেয়েকে তুলে নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে গণধর্ষণ

ডায়রিয়া আক্রান্ত মায়ের সেবায় রাতে হাসপাতালে অবস্থান করছিল সপ্তম শ্রেণির কিশোরী শিক্ষার্থী (১৩)। রাত ১টার দিকে প্রকৃতির ডাকে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ডায়রিয়া ওয়ার্ড সংলগ্ন টয়লেটে যাচ্ছিল সে। এমন সময় ফিল্মি স্টাইলে চার দুর্বৃত্ত টয়লেটের করিডোর থেকেই কিশোরীকে কাঁধে তুলে নিয়ে যায়।

হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী কবরস্থান সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। ঘণ্টাখানেক পর স্থানীয়দের সহযোগিতায় হাসপাতালের দায়িত্বরতরা কিশোরীকে বিবস্ত্র ও বিধ্বস্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।

এ ঘটনায় হাসপাতালের দায়িত্বরত দুই সিকিউরিটি গার্ড দুর্বৃত্তদের সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা হাসপাতালে সোমবার (৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে ঘটে এ ঘটনা। কিশোরী সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এখানেই শেষ নয়। উদ্ধারের পর ভয়ার্ত কিশোরী বিনা চিকিৎসায় অসুস্থ মায়ের সঙ্গে হাসপাতালেই ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে দুর্বৃত্তদের পক্ষ থেকে ঘটনার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করলে জানে মেরে ফেলা হবে বলে মা-মেয়েকে হুমকি দেয়া হয়। তাই কাউকে কিছু না বলে দুপুরে হাসপাতালে এসে কর্তৃপক্ষের অনুুমতি ছাড়াই মা-মেয়েকে বিকেলে বাড়ি নিয়ে যান মেয়ের বাবা।

খবর পেয়ে হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরী এসে ঘটনার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। মা-মেয়েকে বাড়ি নেয়ার কথা শুনে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি অবহিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এরপরই মঙ্গলবার রাতে ওই কিশোরীকে বাড়ি থেকে থানায় এনে জবানবন্দি নেয়ার পর কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ।

এরপরই সংঘটিত ঘটনা প্রচার পায় এবং নিন্দার ঝড় ওঠে। এত বড় ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেও তৎক্ষণাৎ বা সকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাতে দায়িত্বরত কেউ কিছু জানায়নি, এটিই বড় অবাক করা বিষয়। ঘটনায় জড়িত দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানাও কেউ প্রকাশ করতে চাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জালিয়াপালং ইউনিয়নের পূর্ব সোনারপাড়ার কলিম উল্লাহর স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগমকে ডায়রিয়া আক্রান্ত অবস্থায় সোমবার রাতে হাসপাতালে আনা হয়। তাকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ১নং বেডে ভর্তি করা হলে মায়ের সেবায় কিশোরী মেয়েকে রেখে বাড়ি চলে যান কলিম উল্লাহ (৪০)। এবং ওই রাতের শেষ প্রহরেই টয়লেটে যাওয়ার সময় হাসপাতালের করিডোর থেকে তার মেয়েকে দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় হাসপাতালের রোগীরা চেঁচামেচি করলে স্থানীয় লোকজন ও হাসপাতালে রাতে দায়িত্বরত কয়েকজন নাইটগার্ড উত্তর পাশের বাউন্ডারি ওয়াল সংলগ্ন কবরস্থান থেকে বিবস্ত্র অবস্থায় কিশোরীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে বলে উদ্ধারকারী স্থানীয় নজরুল কাশেম, আক্কাস, খাইরু, মুজিবসহ আরো কয়েকজন জানান।

স্থানীয় সূত্র মতে, হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা কালু মিস্ত্রির বখাটে ছেলে গিয়াস উদ্দিন, নুরুল আলম মিস্ত্রির ছেলে মুহাম্মদ হাসেম, মনজুর আলম ও ফারুক উদ্দিন দুই নাইটগার্ডের সহযোগিতায় এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।

কিশোরীর বাবা কলিম উল্লাহ বলেন, মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হাসপাতাল। এর ভেতর থেকে যদি ফিল্মি স্টাইলে মেয়ে তুলে নিয়ে যায় তবে সাধারণ মানুষ আর কোথায় নিরাপদ? এমন প্রশ্ন করে কলিম উল্লাহ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আরো বলেন, দুর্বৃত্তরা এ ঘটনায় বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়ায় মা-মেয়েকে দ্রুত বাড়ি নিয়ে যান।

হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটি নজিরবিহীন ও ন্যক্কারজনক ঘটনা। হাসপাতালে দায়িত্বরত মোজাম্মেল ও রাশেদ নামের দুেই সিকিউরিটি গার্ডের অসংলগ্ন কথায় বোঝা যায় তারা ঘটনায় জড়িত। তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।

হাসপাতাল সংলগ্ন রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ড সদস্য উপজেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি সরওয়ার কামাল পাশা বলেন, হাসপাতালে আগত রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। পরিচিত কিছু সন্ত্রাসী সর্বদা হাসপাতালে আগতদের উত্ত্যক্ত করে। ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

উখিয়া হাসপাতালের প্রধান সহকারী ফরিদুল আলম ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার রাতে হাসপাতালে সরকারি দুজন, আইওএম’র দুজন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দুজন ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসের একজন আনসার ও ভিডিপি সদস্যসহ মোট সাতজন নাইটগার্ড কর্মরত ছিল। এতো নিরাপত্তার পরও কীভাবে সন্ত্রাসীরা হাসপাতাল থেকে রোগির মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করলো এবং ঘটনার সম্পর্কে নাইটগার্ডরা কাউকে কিছু জানালো না তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

ওই রাতে উখিয়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ডা. আরিফা মেহের রুমী হাসপাতাল থেকে কিশোরী তুলে নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকি। তাই হাসপাতালের কোয়ার্টার ছেড়ে কক্সবাজার আসা যাওয়া করতে হচ্ছে।

তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ সংঘটিত ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে বুধবার বিকেলে হাসপাতাল হলরুমে উপজেলা প্রশাসনের একটি বৈঠক হয়েছে। অভিযোগ ওঠা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক দ্রুত বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উখিয়া থানা পুলিশের ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, ঘটনার সম্পর্কে জানতে পেরে বাড়ি থেকে কিশোরীকে এনে জবানবন্দি নিয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে কিশোরীকে পুলিশি নিরাপত্তায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গিয়াস উদ্দিনসহ অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই