স্কুলে গেলে ওরা আমাদের গুলি করবে

‘স্কুলে গেলে ওরা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে, তাই আমরা স্কুলে যেতে ভয় পাই।’ স্কুলে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে এভাবেই উত্তর দিল বাবুছড়ার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিশুরা।

১০ জুনের ঘটনার পর ১২ জুন থেকে খাগড়াছড়ির বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত ৭ শিশুই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অবস্থিত ২নং বাঘাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বৈশাখী চাকমা, সজিব চাকমা, সূর্যধন চাকমা, চতুর্থ শ্রেণীর সুপান্ত চাকমা, দ্বিতীয় শ্রেণীর রেশমী চাকমারা কেউই তাদের সেই স্কুলে যেতে চায়না আর। তারা তাদের স্কুল মাঠে বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনেছে গত ১০ জুন বিকেলে। ওই মাঠে তাদের মা-বাবার ওপর বিজিবি-পুলিশ গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে।

বৈশাখী চাকমার মা বনিতা চাকমা বলেন, ‘এই মুহূর্তে ওই স্কুলটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র, আমরা আমাদের বাচ্চাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিতে পারিনা।’

সজিববের মা পিংকি চাকমা ও সুপান্তর মা সাধনা চাকমা জানান, তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য অভয় দিলেও বাচ্চারা বিজিবি-পুলিশের ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুলের চারদিকে বিজিবিরা স্থাপনা গড়ে তুলেছে এবং স্কুলটিকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অচিন্ত বিকাশ চাকমা জানান, ঘটনার পর থেকে রমজানের ছুটির বন্ধের আগেই শিশুরা বিদ্যালয়ে আসেনি। এলাকায় বিজিবি প্রবেশের পর থেকেই শিশুদের উপস্থিতি একটু কম বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, আগে বিদ্যালয়ের চারদিক খোলা ছিল, শিশুরাও আসতো চারদিক থেকে। বিদ্যালয়টির পেছন দিকে একটি মাত্র রাস্তা রেখে চারদিক কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করায় শিশুদের বিদ্যালয়ে আসা রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিদ্যালয় এলাকা কাঁটাতারে ঘেরার ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মাসুদ করিম বলেন, ‘বিজিবির সদস্যরা প্রথমে না বুঝে বিদ্যালয়কে ঘিরে কাঁটাতার দিয়ে ফেলেছে, বেড়া তুলে ফেলার জন্য তাদের বলা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে নবসৃষ্ট চার নম্বর ব্যাটালিয়ন ৫১ বিজিবির সদর দপ্তরের জন্য দীঘিনালার ৫১নং বাবুছড়ার মৌজাস্থ শশীমোহন কার্বারী পাড়ার ৪৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব করে ভূমি মালিকদের ভূমি হুকুম দখল নোটিশ পাঠানো হলে ১০ জন রেকর্ডকৃত ভূমির মালিক অধিগ্রহণ প্রত্যাহারের জন্য হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসন রিট মামলাভুক্ত ভূমি বাদ দিয়ে ২৯.৮১ একর ভূমি চুড়ান্তভাবে অধিগ্রহণ করে গত ১৫ মে ২০১৪ বিজিবি খাগড়াছড়ি সেক্টর সদর দপ্তরকে হস্তান্তর করে। রিট মামলাভুক্ত জমি বাদ দিলে বাকি ভূমিও দখলসত্ত্ব মালিকানাধীন বলে দাবি করে অধিগ্রহণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে গ্রামবাসী। কিন্তু আদিবাসীদের দাবি আমলে না নিয়ে শেষ পর্যন্ত অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক।

দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর রিট মামলার শুনানি চলে। মামলার রায় হওয়ার আগেই এবং পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন করে ৫১ বিজিবি ১৪ মে ২০১৪ রাত ৩টার দিকে পুরো ব্যাটালিয়ন গাড়ি বহর নিয়ে প্রস্তাবিত ভূমিতে প্রবেশ করে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন শুরু করে। অবস্থানের পরপরই বিজিবির সদস্যরা গ্রামের চারদিক কাঁটাতারের বেড়া দিলে এতে গ্রামবাসীরা আপত্তি জানায়। সর্বশেষ ১০ জুন বিকেল ৫টার দিকে এ সমস্যা নিয়ে গ্রামের নারীদের সঙ্গে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে বিজিবি গ্রামের নারীদের ওপর চড়াও হয়ে হামলা করে। পরে উভয়পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয় এবং আরেক পর্যায়ে বিজিবি ও পুলিশ গ্রামবাসীর ওপর ১০ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ৩ জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১৮ নারী আহত হয়।

এ ঘটনায় সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগ এনে বিজিবি বাদী হয়ে আড়াই শতাধিক গ্রামবাসীকে আসামি করে দীঘিনালা থানায় একটি মামলা দায়ের করে ৬ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে অপ্সরী চাকমা নামে একজন সদ্য এসএসসি পাশ ছাত্রী রয়েছে। বর্তমানে ২ জন জামিনে মুক্ত থাকলেও বাকিদের কারাগারে রাখা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই