সৌন্দর্য্য ও প্রেম
সৌন্দর্য্যের কারণ: পূর্ব্বে এক স্থানে বলিয়াছি, যে, যখন জগতের স্বপক্ষে থাকি তখনই আমাদের প্রকৃত সুখ, যখন স্বার্থ খুঁজিয়া মরি তখনই আমাদের ক্লেশ, শ্রান্তি, অসন্তোষ। ইহা হইতে আর-একটা কথা মনে আসে। যাহাদিগকে আমরা সুন্দর বলি তাহাদিগকে আমাদের কেন ভাল লাগে?
পণ্ডিতেরা বলেন, যে সুন্দর তাহার মধ্যে বিষম কিছুই নাই; তাহার আপনার মধ্যে আপনার পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য; তাহার কোন-একটি অংশ অপর-একটি অংশের সহিত বিবাদ করে না; জেদ করিয়া অন্য সকলকে ছাড়াইয়া উঠে না; ঈর্ষ্যাবশতঃ স্বতন্ত্র হইয়া মুখ বাঁকাইয়া থাকে না। তাহার প্রত্যেক অংশ সমগ্রের সুখে সুখী; তাহারা ভাবে “আমরা যে আপনারা সুন্দর সে কেবল সমগ্রকে সুন্দর করিয়া তুলিবার জন্য’। তাহারা যদি স্বস্বপ্রধান হইত, তাহারা যদি সকলেই মনে করিত “আর সকলের চেয়ে আমিই মস্ত লোক হইয়া উঠিব’, একজন আর এক জনকে না মানিত, তাহা হইলে, না তাহারা নিজে সুন্দর হইত, না তাহাদের সমগ্রটি সুন্দর হইয়া উঠিত। তাহা হইলে একটা বাঁকাচোরা হ্রস্বদীর্ঘ উঁচুনীচু বিশৃঙ্খল চক্ষুশূল জন্মগ্রহণ করিত। অতএব দেখা যাইতেছে, যথার্থ যে সুন্দর সে প্রেমের আদর্শ। সে প্রেমের প্রভাবেই সুন্দর হইয়াছে; তাহার আদ্যন্তমধ্য প্রেমের সূত্রে গাঁথা; তাহার কোনখানে বিরোধ বিদ্বেষ নাই। প্রেমের শতদল একটি বৃন্তের উপরে কি মধুর প্রেমে মিলিয়া থাকে! তাই তাহাকে দেখিতে ভাল লাগে। তাহার কোমলতা মধুর; কারণ কোমলতা প্রেম, কোমলতা কাহাকেও আঘাত করে না, কোমলতা সকলের গায়ে করুণ হস্তক্ষেপ করে, সে চোখের পাতায় স্নেহ আকর্ষণ করিয়া আনে। ইন্দ্রধনুর রংগুলি প্রেমের রং, তাহাদের মধ্যে কেমন মিল! তাহারা সকলেই সকলের জন্য জায়গা রাখিয়াছে, কেহ কাহাকেও দূর করিতে চায় না, তাহারা সুরবালিকাদের মত হাত-ধরাধরি করিয়া দেখা দেয়, গলাগলি করিয়া মিলাইয়া যায়। গানের সুরগুলি প্রেমের সুর, তাহারা সকলে মিলিয়া খেলাইতে থাকে, তাহারা পরস্পরকে সাজাইয়া দেয়, তাহারা আপনার সঙ্গিনীদের দূর হইতে ডাকিয়া আনে! এই জন্যই সৌন্দর্য্য মনের মধ্যে প্রেম জন্মাইয়া দেয়, সে আপনার প্রেমে অন্যকে প্রেমিক করিয়া তুলে, সে আপনি সুন্দর হইয়া অন্যকে সুন্দর করে।
সৌন্দর্য্য বিশ্বপ্রেমী
যে সুন্দর, কেবল যে তাহার নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে তাহা নয়; সৌন্দর্য্যের সামঞ্জস্য সমস্ত জগতের সঙ্গে। সৌন্দর্য্য জগতের অনুকূল। কদর্য্যতা সয়তানের দলভুক্ত। সে বিদ্রোহী। সে যে টিঁকিয়া থাকে সে কেবল মাত্র গায়ের জোরে। তাও সে থাকিত না, কারণ কতটুকুই বা তাহার গায়ে জোর — কিন্তু প্রকৃতি তাহা হইতেও বুঝি সৌন্দর্য্য অভিব্যক্ত করিবেন।
মনের মিল
জগতের সাধারণের সহিত সৌন্দর্য্যের আশ্চর্য্য ঐক্য আছে। জগতের সর্ব্বত্রই তাহার তুলনা, তাহার দোসর মেলে। এই জন্য সৌন্দর্য্যকে সকলের ভাল লাগে। সৌন্দর্য্য যদি একেবারেই নূতন হইত, খাপছাড়া হইত, হঠাৎ-বাবুর মত একটা কিম্ভূত পদার্থ হইত, তাহা হইলে কি তাহাকে আর কাহারো ভাল লাগিত?
আমাদের মনের মধ্যেই এমন একটা জিনিষ আছে, সৌন্দর্য্যের সহিত যাহার অত্যন্ত ঐক্য হয়। এজন্য সৌন্দর্য্যকে দেখিবামাত্র তৎক্ষণাৎ “আমার মিত্র” বলিয়া মনে হয়। জগতে আমরা “সদৃশকে” খুঁজিয়া বেড়াই। যথার্থ সদৃশকে দেখিলেই হৃদয় অগ্রসর হইয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া ডাকিয়া আনে। কিন্তু সৌন্দর্য্যের মধ্যে যেমন আমাদের সাদৃশ্য দেখিতে পাই, এমন আর কোথায়? সৌন্দর্য্যকে দেখিলে তাহাকে আমাদের “মনের মত” বলিয়া মনে হয় কেন? সে-ই আমাদের মনের সঙ্গে ঠিক মেলে, কদর্য্যতার সঙ্গে আমাদের মনের মিল হয় না।
আমরা সকলেই যদি কিছু না কিছু সুন্দর না হইতাম, তাহা হইলে সুন্দর ভাল বাসিতাম না!
উপযোগিতা
যাহা আমাদের উপকারী ও উপযোগী, তাহাই কালক্রমে অভ্যাসবশতঃ আমাদের চক্ষে সুন্দর বলিয়া প্রতীত হয় ও বংশপরম্পরায় সেই প্রতীতি প্রবাহিত ও পরিপুষ্ট হইতে থাকে, এরূপ কথা কেহ কেহ বলিয়া থাকেন। তাহা যদি সত্য হইত তাহা হইলে লোকে অবসর পাইলে ফুলের বাগানে বেড়াইতে না গিয়া ময়রার দোকানে বেড়াইতে যাইত, ঘরের দেয়ালে লুচি টাঙ্গাইয়া রাখিত ও ফুলদানীর পরিবর্ত্তে সন্দেশের হাঁড়ি টেবিলের উপর বিরাজ করিত!
আমরা সুন্দর
প্রকৃত কথা এই যে, আমরা বাহিরে যেমনই হই-না কেন, আমরা বাস্তবিকই সুন্দর। সেই জন্য সৌন্দর্য্যের সহিতই আমাদের যথার্থ ঐক্য দেখিতে পাই। এই সৌন্দর্য্য-চেতনা সকলের কিছু সমান হয়। যাহার হৃদয়ে যত সৌন্দর্য্য বিরাজ করিতেছে, সে ততই সৌন্দর্য্য উপভোগ করিতে পারে। সৌন্দর্য্যের সহিত তাহার নিজের ঐক্য ততই সে বুঝিতে পারে ও ততই সে আনন্দ লাভ করে। আমি যে ফুল এত ভালবাসি তাহার কারণ আর কিছু নয়, ফুলের সহিত আমার হৃদয়ের গূঢ় একটি ঐক্য আছে — আমার মনে হয় ও একই কথা, যে সৌন্দর্য্য ফুল হইয়া ফুটিয়াছে সেই সৌন্দর্য্যই অবস্থাভেদে আমার হৃদয় হইয়া বিকশিত হইয়াছে; সেই জন্য ফুলও আমার হৃদয় চাহিতেছে, আমিও ফুলকে আমার হৃদয়ের মধ্যে চাহিতেছি। মনের মধ্যে একটি বিলাপ উঠিতেছে যে, আমরা এক পরিবারের লোক, তবে কেন অবস্থান্তর নামক দেয়ালের আড়ালে পর হইয়া বাস করিতেছি? কেন পরস্পরকে সর্ব্বতোভাবে পাইতেছি না?
সুদূর ঐক্য
সৌন্দর্য্যের ঐক্য দেখিয়াই বিক্টর হ্যুগো গান গাহিতেছেন।
মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম
সূর্য্য ধায় লভিবারে বিশ্রামের ঘুম।
ভাঙ্গা এক ভিত্তি-‘পরে ফুল শুভ্রবাস,
চারি দিকে শুভ্রদল করিয়া বিকাশ
মাথা তুলে চেয়ে দেখে সুনীল বিমানে
অমর আলোকময় তপনের পানে;
ছোট মাথা দুলাইয়া কহে ফুল গাছে,
“লাবণ্য-কিরণ-ছটা আমারো ত আছে! ”
“লক্ষান্তরেহর্কশ্চ জলেষু পদ্মঃ ” ইহাদের মধ্যেও ঐক্য!
সুন্দর সুন্দর করে
সুন্দর আপনি সুন্দর এবং অন্যকে সুন্দর করে। কারণ, সৌন্দর্য্য হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত করিয়া দেয় এবং প্রেমই মানুষকে সুন্দর করিয়া তুলে। শারীরিক সৌন্দর্য্যও প্রেমে যেমন দীপ্তি পায় এমন আর কিছুতে না। মানুষের মিলনে যেমন প্রেম আছে, পশুদের মিলনে তেমন প্রেম নাই, এই জন্য বোধ করি, পশুদের অপেক্ষা মানুষের সৌন্দর্য্য পরিস্ফুটতর। যে মানুষ ও যে জাতি পাশব, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, সে মানুষের ও সে জাতির মুখশ্রী সুন্দর হইতে পারে না। দেখা যাইতেছে, দয়ায় সুন্দর করে, প্রেমে সুন্দর করে, হিংসায় নিষ্ঠুরতায় সৌন্দর্য্যের ব্যাঘাত জন্মায়। জগতের অনুকূলতাচরণ করিলে সুন্দর হইয়া উঠি ও প্রতিকূলতা করিলে জগৎ আমাদের গালে কদর্য্যতার চুনকালি মাখাইয়া তাহার রাজপথে ছাড়িয়া দেয়, আমাদিগকে কেহ সমাদর করিয়া আশ্রয় দেয় না।
শাস্তি
এ শাস্তি বড় সামান্য নয়। আমাদের নিজের মধ্যে সৌন্দর্য্যের ন্যূনতা থাকিলে, আমরা জগতের সৌন্দর্য্য-রাজ্যে প্রবেশাধিকার পাই না, ধরণীর ধুলা-কাদার মধ্যে লুটাইতে থাকি। শব্দ শুনি, গান শুনি না; চলাফিরা দেখিতে পাই, নৃত্য দেখিতে পাই না; আহার করিয়া পেট ভরাই, কিন্তু সুস্বাদ কাহাকে বলে জানি না। জগতের যে অংশে কারাগার সেইখানে গর্ত্ত খুঁড়িয়া অত্যন্ত নিরাপদে বৈষয়িক কেঁচো হইয়া বুড়া বয়স পর্য্যন্ত কাটাইয়া দিই, মৃত্তিকার তলবাসী চক্ষুবিহীন কৃমিদের সহিত কুটুম্বিতা করি, ও তাহাদের সহিত জড়িত বিজড়িত হইয়া স্তূপাকারে নিদ্রা দিই।
উদ্ধার
এই কৃমিরাজ্য হইতে উদ্ধার পাইয়া আমরা সূর্য্যালোকে আসিতে চাই। কে আনিবে? সৌন্দর্য্য স্বয়ং। কারণ, অশরীরী প্রেম সৌন্দর্য্যে শরীর ধারণ করিয়াছে। প্রেম যেখানে ভাব, সৌন্দর্য্য সেখানে তাহার অক্ষর; প্রেম যেখানে হৃদয়, সৌন্দর্য্য সেখানে গান; প্রেম যেখানে প্রাণ, সৌন্দর্য্য সেখানে শরীর; এই জন্য সৌন্দর্য্যে প্রেম জাগায় এবং প্রেমে সৌন্দর্য্য জাগাইয়া তুলে।
কবির কাজ
কবিদের কি কাজ এইবার দেখা যাইতেছে। সে আর কিছু নয়, আমাদের মনে সৌন্দর্য্য উদ্রেক করিয়া দেওয়া। উপদেশ দিয়া তত্ত্বনির্ণয় করিয়া প্রকৃতিকে মৃতদেহের মত কাটাকুটি করিয়া এ উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না। সুন্দরই সৌন্দর্য্য উদ্রেক করিতে পারে। বৈষয়িকেরা বলেন ইহাতে লাভটা কি? কেবলমাত্র একটি সুন্দর ছবি পাইয়া, বা সুন্দর কথা শুনিয়া উপকার কি হইল? কি জানিলাম? কি শিক্ষা লাভ করিলাম? সঞ্চয়ের খাতায় কোন্ নূতন কড়িটা জমা করিলাম? কিছুক্ষণের মত আনন্দ পাইলাম, সে ত সন্দেশ খাইলেও পাই। ততক্ষণ যদি পাঁজি দেখিতাম, তবে আজকেকার তারিখ বার ও কবে চন্দ্রগ্রহণ হইবে সে খবরটা জানিতে পাইতাম।
বৈষয়িকেরা যাহাই বলুন-না কেন, আর কোন উদ্দেশ্যের আবশ্যক করে না, মনে সৌন্দর্য্য উদ্রেক করাই যথেষ্ট মহৎ। কবিতার ইহা অপেক্ষা মহত্তর উদ্দেশ্য আর থাকিতে পারে না। সৌন্দর্য্য উদ্রেক করার অর্থ আর কিছু নয় — হৃদয়ের অসাড়তা অচেতনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, হৃদয়ের স্বাধীনতাক্ষেত্র প্রসারিত করিয়া দেওয়া। সে কার্য্যে যাঁহারা ব্রতী, তাঁহাদের সহিত একটি ময়রার তুলনা ঠিক খাটে না।
অতএব কবিদিগকে আর কিছুই করিতে হইবে না, তাঁহারা কেবল সৌন্দর্য্য ফুটাইতে থাকুন — জগতের সর্ব্বত্র যে সৌন্দর্য্য আছে তাহা তাঁহাদের হৃদয়ের আলোকে পরিস্ফুট ও উজ্জ্বল হইয়া আমাদের চোখে পড়িতে থাকুক, তবেই আমাদের প্রেম জাগিয়া উঠিবে, প্রেম বিশ্বব্যাপী হইয়া পড়িবে।
কবিতা ও তত্ত্ব
কবিরা যদি একটি তত্ত্ববিশেষকে সমুখে খাড়া করিয়া তাহারই গায়ের মাপে ছাঁট-ছোঁট করিয়া কবিতার মেরজাই ও পায়জামা বানাইতে থাকেন, ও সেই পোষাকে সুসজ্জিত করিয়া তত্ত্বকে সমাজে ছাড়িয়া দেন, তবে সে তত্ত্বগুলিকে কেমন খোকাবাবুর মত দেখায় ও সে কাজটাও ঠিক কবির উপযুক্ত হয় না। এক-একবার এমন দর্জ্জীবৃত্তি করিতে দোষ নাই, এবং মোটা মোটা বয়স্ক তত্ত্বেরা যদি মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান-বিশেষের সময়ে তাঁহাদের থানধুতি ছাড়িয়া এইরূপ পোষাক পরিয়া সভায় আসিয়া উপস্থিত হন তাহাতেও তেমন আপত্তি দেখি না। কিন্তু এই যদি প্রথা হইয়া পড়ে, কবিতাটি দেখিলেই যদি দশজনে পড়িয়া তাহার খোলা ও শাঁস ছাড়াইয়া ফেলিয়া তাহা হইতে তত্ত্বের আঁটি বাহির করাই প্রধান কর্ত্তব্য বিবেচনা করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ক্রমে এমন ফলের চাষ হইতে আরম্ভ হইবে, যাহার আঁটিটাই সমস্ত, এবং যে সকল ফলের মধ্যে আঁটির বাহুল্য থাকিবে না শাঁস এবং মধুর রসই অধিক, তাহারা নিজের আঁটিদরিদ্র অস্তিত্ব ও মাধুর্য্য-রসের আধিক্য লইয়া নিতান্ত লজ্জা অনুভব করিবে। তখন গহনা-পরা গরবিনীকে দেখিয়া ভুবনমোহিনী রূপসীরাও ঈর্ষ্যাদগ্ধ হইবে।
তত্ত্বের বার্দ্ধক্য
তত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞান পুরাতন হইয়া যায়, মৃত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া যায়। আজ যে জ্ঞানটি নানা উপায়ে প্রচার করিবার আবশ্যক থাকে, কাল আর থাকে না, কাল তাহা সাধারণের সম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। কাল যদি পুনশ্চ সে কথা উত্থাপন করিতে যাও তবে লোকে তোমাকে মারিতে আসে; বলে, ” আমি কি জাহাজ হইতে নামিয়া আসিলাম, না আমি কাল জন্মগ্রহণ করিয়াছি? ” জ্ঞান একটু পুরাতন হইলেই তাহার পুনরুক্তি আর কাহারও সহ্য হয় না। অনেক জ্ঞান কালক্রমে লোপ পায়, পরিবর্ত্তিত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া পড়ে। এমন একদিন ছিল যখন, আমরা শব্দ যে কানেই শুনি সর্ব্বাঙ্গ দিয়া শুনি না, এ কথাটাও নূতন সত্য ছিল। তখন এ কথাটা প্রমাণ দিয়া বুঝাইতে হইত। কিন্তু হৃদয়ের কথা চিরকাল পুরাতন এবং চিরকাল নূতন। বাল্মীকির সময়ে যে-সকল তত্ত্ব সত্য বলিয়া প্রচলিত ছিল, তাহাদের অনেকগুলি এখন মিথ্যা বলিয়া স্থির হইয়াছে, কিন্তু সেই প্রাচীন ঋষি-কবি হৃদয়ের যে চিত্র দিয়াছেন তাহার কোনটাই এখনও অপ্রচলিত হয় নাই।
অতএব জ্ঞান কবিতার বিষয় নহে। কবিতা চিরযৌবনা। এই বুড়ার সহিত বিবাহ দিয়া তাহাকে অল্প বয়সে বিধবা ও অনুমৃতা করা উচিত হয় না।
সৌন্দর্য্যের কাজ
প্রকৃতির উদ্দেশ্য — জানানো নহে, অনুভব করানো। চারি দিক হইতে কেবল নানা উপায়ে হৃদয়-আকর্ষণের চেষ্টা হইতেছে। যে জড়হৃদয় তাহাকেও মুগ্ধ করিতে হইবে, দিবানিশি তাহার কেবল এই যত্ন। তাহার প্রধান ইচ্ছা এই যে, সকলের সকল ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে আপনাকে বা অপরকে কেহ যেন বিনাশ না করে, এত ভাল লাগে যে সকলে সকলের অনুকূল হয়। কারণ, এই ইচ্ছার উপর তাহার সমস্ত শুভ তাহার অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। প্রথম অবস্থায় শাসনের দ্বারা প্রকৃতির এই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। প্রথমে দেখিলে — জগৎকে ঘুষি মারিলে তোমার মুষ্টিতে গুরুতর আঘাত লাগে, ক্রমে দেখিলে — জগতের সাহায্য করিলে সেও তোমার সাহায্য করে। এরূপ শাসনে এরূপ স্বার্থপরতায় জগতের রক্ষা হয় বটে; কিন্তু তাহাতে আনন্দ কিছুই নাই, তাহাতে জড়ত্ব ও দাসত্বই অধিক। এই জন্য প্রকৃতিতে যেমন শাসনও আছে তেমনি সৌন্দর্য্যও আছে। প্রকৃতির অভিপ্রায় এই, যাহাতে শাসন চলিয়া গিয়া সৌন্দর্য্যের বিস্তার হয়। শাসনের রাজদণ্ড কাড়িয়া লইয়া সৌন্দর্য্যের মাথায় রাজছত্র ধরাই প্রকৃতির চরম উদ্দেশ্য। প্রকৃতি যদি নিষ্ঠুর শাসনপ্রিয় হইত, তাহা হইলে সৌন্দর্য্যের আবশ্যকই থাকিত না। তাহা হইলে প্রভাত মধুর হইত না, ফুল মধুর হইত না, মনুষ্যের মুখশ্রী মধুর হইত না। এই সকল মাধুর্য্যের দ্বারা বেষ্টির হইয়া আমরা ক্রমশঃ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হইতেছি। আমরা ভালবাসিব বলিয়া জগতের হিত সাধন করিব। তখন ভয় কোথায় থাকিবে! তখন সৌন্দর্য্য জগতের চতুর্দ্দিকে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে! অর্থাৎ আমাদের হৃদয়কমলশায়ী সুপ্ত সৌন্দর্য্য জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি জাগিয়াই আমাদের চতুর্দ্দিকস্থ শাসনের সিপাহীগুলোর নাম কাটিয়া দিয়াছেন, জগতের চারি দিকে তাঁহার জয়জয়কার উঠিয়াছে।
স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক
কবিরা সেই সৌন্দর্য্যের কবি, তাঁহারা সেই স্বাধীনতার গান গাহিতেছেন, তাঁহারা সজীব মন্ত্রবলে হৃদয়ের বন্ধন মোচন করিতেছেন। তাঁহারা সেই শাসনহীন স্বাধীনতার জন্য আমাদের হৃদয়ে সিংহাসন নির্ম্মাণ করিতেছেন, সেই মহারাজা-কর্ত্তৃক রক্তপাতহীন জগৎজয়ের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছেন; কবিরা তাঁহারই সৈন্য। তাঁহারা উপদেশ দিতে আসেন নাই। সজীবতা ও সৌন্দর্য্য লাভ করিবার জন্য কখন কখন তত্ত্ব তাঁহাদের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হয়, তাঁহারা তত্ত্বর কাছে কখন উমেদারী করিতে যান না। কবিরা অমর, কেননা তাঁহাদের বিষয় অমর, অমরতাকে আশ্রয় করিয়াই তাঁহারা গান গাহিয়াছেন। ফুল চিরকাল ফুটিবে, সমীরণ চিরকাল বহিবে, পাখী চিরকাল ডাকিবে, এবং এই ফুলের মধ্যে কবির স্মৃতি বিকশিত, এই সমীরণের মধ্যে কবির স্মৃতি প্রবাহিত, এই পাখীর গানে কবির গান বাজিয়া ওঠে। কবির নাম নির্জ্জীব পাথরের মধ্যে খোদিত নহে, কবির নাম প্রভাতের নব নব বিকশিত বিচিত্রবর্ণ ফুলের অক্ষরে প্রত্যহ নূতন করিয়া লিখিত হয়। কবি প্রিয়, কারণ, তিনি যাহাদিগকে ভালবাসিয়া কবি হইয়াছেন তাহারা চিরকাল প্রিয়, কোনকালে তাহারা অপ্রিয় ছিল না, কোন-কালে তাহারা অপ্রিয় হইবে না।
পুরাতন কথা
যাঁহারা বলেন ” সকল কবিরা ঐ এক কথাই বলিয়া আসিতেছেন, নূতন কি বলিতেছেন? ” তাঁহাদের কথার আর উত্তর দিবার কি আবশ্যক আছে? এক কথায় তাঁহাদের উত্তর দেওয়া যায়। পুরাতন কথা বলেন বলিয়াই কবিরা কবি। তাঁহারা নূতন কথা বলেন না, নূতনকে বিশ্বাস করে কে? নূতনকে অসন্দিগ্ধচিত্তে প্রাণের অন্তঃপুরের মধ্যে কে ডাকিয়া লইয়া যাইতে পারে? তাহার বংশাবলীর খবর রাখে কে? কবিরা এমন পুরাতন কথা বলেন যাহা আমার পক্ষেও খাটে, তোমার পক্ষেও খাটে; যাহা আজও আছে, কালও ছিল, আগামী কালও থাকিবে। যাহা শুনিবামাত্র সুদূর অতীত হইতে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্য্যন্ত সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিতে পারে, ঠিক কথা! যাহা শুনিয়া আমরা সকলেই আনন্দে বলিতে পারি — পরের হৃদয়ের সহিত আমার হৃদয়ের কি আশ্চর্য্য যোগ, অতীত কালের হৃদয়ের সহিত বর্ত্তমান কালের হৃদয়ের কি আশ্চর্য্য ঐক্য! হৃদয়ের ব্যাপ্তি মুহূর্ত্তের মধ্যে বাড়িয়া যায়!
জ্ঞান ও প্রেম
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে জ্ঞানে প্রেমে অনেক প্রভেদ। জ্ঞানে আমাদের ক্ষমতা বাড়ে, প্রেমে আমাদের অধিকার বাড়ে। জ্ঞান শরীরের মত, প্রেম মনের মত। জ্ঞান কুস্তি করিয়া জয়ী হয়, প্রেম সৌন্দর্য্যের দ্বারা জয়ী হয়। জ্ঞানের দ্বারা জানা যায় মাত্র, প্রেমের দ্বারা পাওয়া যায়। জ্ঞানেতেই বৃদ্ধ করিয়া দেয়, প্রেমেতেই যৌবন জিয়াইয়া রাখে। জ্ঞানের অধিকার যাহার উপরে তাহা চঞ্চল, প্রেমের অধিকার যাহার উপরে তাহা ধ্রুব। জ্ঞানীর সুখ আত্মগৌরব-নামক ক্ষমতার সুখ, প্রেমিকের সুখ আত্মবিসর্জ্জন-নামক স্বাধীনতার সুখ।
নগদ কড়ি
জ্ঞান যাহা জানে তাহা প্রকৃত জানাই নয়, প্রেম যাহা জানে তাহাই যথার্থ জানা। একজন জ্ঞানী ও প্রেমিকের নিকটে এই সম্বন্ধে একটি পারস্য কবিতার চমৎকার ব্যাখ্যা শুনিয়াছিলাম, তাহার মর্ম্ম লিখিয়া দিতেছি।
পারস্য কবি এইরূপ একটি ছবি দিতেছেন যে, বৃদ্ধ পক্বকেশ জ্ঞান তাহার লোহার সিন্দুকে চাবি লাগাইয়া বসিয়া আছে; হৃদয় “নগদ কড়ি দাও” “নগদ কড়ি দাও” বলিয়া তাহারই কাছে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে, প্রেম এক পাশে বসিয়াছিল, সে হাসিয়া বলিতেছে “মুস্কিল! ”
অর্থাৎ, জ্ঞান নগদ কড়ি পাইবে কোথায়! সে ত কতকগুলো নোট দিতে পারে মাত্র, কিন্তু সেই নোট ভাঙ্গাইয়া দিবে এমন পোদ্দার কোথায়! জ্ঞানে ত কেবল কতকগুলো চিহ্ন দিতে পারে মাত্র, কিন্তু সেই চিহ্নের অর্থ বলিয়া দিবে কে? জগতের সকল ব্যাঙ্কে নোটই দেখিতেছি, চিহ্নই দেখিতেছি, হৃদয় ব্যাকুল হইয়া বলিতেছে, নগদ কড়ি পাইব কোথায়? প্রেমের কাছে পাইবে।
আংশিক ও সম্পূর্ণ অধিকার
যেমন শরীরের দ্বারা শরীরকেই আয়ত্ত করা যায়, তেমনি জ্ঞানের দ্বারা বাহ্যবস্তুর উপরেই ক্ষমতা জন্মে, মর্ম্মের মধ্যে তার প্রবেশ নিষেধ।
একজন ইংরাজ স্ত্রীকবি এই সম্বন্ধে যাহা বলিতেছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি। ইহার মর্ম্ম এই যে, যদি অংশ চাও তবে জ্ঞান বা শরীরের দ্বারা পাইবে, তাও ভাল করিয়া পাইবে না; যদি সমস্ত চাও, তবে মন বা প্রেমের দ্বারা পাইবে।
INCLUSIONS
Oh, wilt thou have my hand, Dear,
to lie along in thine?
As a little stone in a running stream,
it seems to lie and pine!
Now drop the poor pale hand, Dear,…
unfit to plight with thine.
Oh, wilt thou have my cheek, Dear,
drawn closer to thine own?
My cheek is white, my cheek is worn,
by many a tear run down.
Now leave a little space, Dear,… lest it
should wet thine own,
Oh, must thou have my soul, Dear,
commingled with thy soul?
Red grows the cheek, and warm the
hand,…the part is in the whole!…
Nor hands nor cheeks keep separate,
when soul is joined to soul.
—– Mrs. Browning.
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী, তুমি শ্রী, তুমি সৌন্দর্য্য, আইস, তুমি আমাদের হৃদয়-কমলাসনে অধিষ্ঠান কর। তুমি যাহার হৃদয়ে বিরাজ কর, তাহার আর দারিদ্র্যভয় নাই; জগতের সর্ব্বত্রই তাহার ঐশ্বর্য্য। যাহারা লক্ষ্মীছাড়া, তাহারা হৃদয়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ পোষণ করিয়া টাকার থলি ও স্থূল উদর বহন করিয়া বেড়ায়। তাহারা অতিশয় দরিদ্র, তাহারা মরুভূমিতে বাস করে; তাহাদের বাসস্থানে ঘাস জন্মায় না, তরুলতা নাই, বসন্ত আসে না।
তুমি বিষ্ণুর গেহিনী। জগতে সর্ব্বত্র তোমার মাতৃস্নেহ। তুমি এই জগতের শীর্ণ কঠিন কঙ্কাল প্রফুল্ল কোমল সৌন্দর্য্যের দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছ। তোমার মধুর করুণ বাণীর দ্বারা জগৎ-পরিবারের বিরোধ বিদ্বেষ দূর করিতেছ। তুমি জননী কিনা, তাই তুমি শাসন হিংসা ঈর্ষ্যা দেখিতে পার না। তুমি বিশ্বচরাচরকে তোমার বিকশিত কমলদলের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া অনুপম সুগন্ধে মগ্ন করিয়া রাখিতে চাও। সেই সুগন্ধ এখনি পাইতেছি; অশ্রুপূর্ণনেত্রে বলিতেছি, ” কোথায় গো! সেই রাঙা চরণ দুখানি আমার হৃদয়ের মধ্যে একবার স্থাপন কর, তোমার স্নেহহস্তের কোমল স্পর্শে আমার হৃদয়ের পাষাণ-কঠিনতা দূর কর।” তোমার চরণ-রেণুর-সুগন্ধে সুবাসিত হইয়া আমার হৃদয়ের পুষ্পগুলি তোমার জগতে তোমার সুগন্ধ দান করিতে থাকুক্!
এই-যে তোমার পদ্মবনের গন্ধ কোথা হইতে জগতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। চরাচর উন্মত্ত হইয়া মধুকরের মত দল বাঁধিয়া গুন্ গুন্ গান করিতে করিতে সুনীল আকাশে চারি দিক হইতে উড়িয়া চলিয়াছে!
মন্তব্য চালু নেই