সেই আটক ব্যক্তি কোথায়?

মিজানুর রহমান খান : গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর হৃদয়বিদারক হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চার লেন উদ্বোধনের পর ঘোষণা দিয়েছিলেন, একজন ‘ধরা’ পড়েছে। একই দিনে আইএসপিআরের মুখপাত্র নির্দিষ্টভাবে বলেছেন, ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করা হয়েছে। এরপর আইজিপি বলেছেন, গোয়েন্দা হেফাজতে দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘ঘটনাস্থল থেকে আটক’ ব্যক্তি সম্পর্কে পরে আর কোনো ঘোষণা আসেনি। তিনি কোথায়?

এমনকি তাঁকে বা এই ঘটনায় কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেই এ পর্যন্ত আদালতে সোপর্দ করা হয়নি। সুতরাং, সেদিক থেকে গুলশানের ঘটনাটি এখন পর্যন্ত দৃশ্যত শুধুই নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্টতানির্ভর হয়ে আছে। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হলো, কেউ ‘আটক’ হন আর ‘গ্রেপ্তার’ হন, তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগে সোপর্দ করতে হবে।

আমরা অবশ্যই আস্থা রাখতে চাই যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যা আছে। তারা হয়তো বিষয়টির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে উদাসীন বা কোনো কারণে তাদের নজর এড়িয়ে আছে, যদিও তা থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে তাদের একটা ব্যাখ্যা দরকার।

সত্যি বলতে কি, প্রধানমন্ত্রীর জবানিতে একজনকে ধরা পড়ার ঘোষণার পর খুবই আশ্বস্ত হয়েছিলাম এবং এখনো আছি। এর আগে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা বেগুনবাড়ি থেকে হামলাকারী এক জঙ্গিকে ধরেছিলেন। আর মাদারীপুরে জনতার হাতে আরেক তরুণ ‘জঙ্গি’ ধরা পড়লেন। কিন্তু তিনি রিমান্ডে থাকতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেন।

এরপর আমরা জানলাম, এ বিষয়ে দায়ের করা মামলার ৬ আসামির সবাই মৃত। ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কি সেই আটক হওয়া ব্যক্তি? তার উত্তর আমাদের অজানা। আবার পুলিশ বলেছে, তাদের হেফাজতে কেউ নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো, যাকে আটক করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো, তিনি কোথায়? এর সদুত্তর দরকার। বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে এখন কেউ গ্রেপ্তার বা প্রহরা আটক থাকলেই দেশের মানুষ আর ঠিক আগের মতো ভরসা পান না। পরপর কয়েকটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৃত্যু পুলিশ হেফাজতকে সব থেকে অনিরাপদ বিশেষ করে ‘জঙ্গি’ ধাঁচের অপরাধের বিচারের পথের বাস্তব বাধা বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

আমরা অবশ্যই এটা স্বীকার করব যে বিশেষ পরিস্থিতি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণকে অনিবার্য করে তুলতে পারে। কিন্তু আইনের শাসনে সেই বিশেষ অবস্থা মোকাবিলায় আইনের আওতায় দরকারে মধ্যরাতে যেকোনো আদালত বসানোর সুযোগ রেখেছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আইন ও সংবিধানের বাইরে যাওয়াকে কোনো যৌক্তিকতা দেয়নি। তাই গুলশানের রক্তাক্ত অধ্যায়, যার ফলোআপ ও সুষ্ঠু তদন্ত ফল জানতে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে, সেখানে বিশ্বকে বলা হচ্ছে না যে সেই আটক বা গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজনকে কেন আদালতে হাজির করা হয়নি। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন বটেই। আর্টিজান তদন্তপ্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ও মান যাচাইয়ের প্রশ্ন থেকেও একে আলাদা করা যাবে না। উপরন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তরফে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ডিউ প্রসেস’ বা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না-করার প্রশ্নটিও নিহিত।

বাংলাদেশের উচিত তদন্তপ্রক্রিয়ার যথার্থতা সম্পর্কে কোনো ধরনের ভুল বার্তা সীমান্তের বাইরে যেতে না দেওয়া।

আমাদের পুলিশ অনেক সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে হামেশা আটকে রাখে, অনির্দিষ্টকাল ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারপর তারা যখন আদালতে চালান করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় যে অমুককে এ কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘোষণাটা আসে এমন একটি সময়ে যখন দেখা যায় পুলিশ অতঃপর ২৪ ঘণ্টার সীমার মধ্যেই তাঁকে আদালতে চালান করেছে এবং তাঁর জামিনের বিরোধিতা ও রিমান্ড প্রার্থনা করেছে।

গুলশানের ঘটনায় এখন কতজন প্রহরায় আটক বা গ্রেপ্তার সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ঘোষণা আমাদের জানা নেই। গ্রেপ্তার ও অলিখিত আটকের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে বাস্তব পার্থক্য সৃষ্টি করেছে, তা সংবিধান সমর্থন করে না। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, সন্দেহের বশে পুলিশ আপনাকে থামাতে পারবে। এই থামানোটাই হলো প্রহরায় আটক, এটা গ্রেপ্তার নয়। কিন্তু যত বড় সন্দেহভাজন হন, কোনো যুক্তিতেই আদালতকে অন্ধকারে রাখা যাবে না।

মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাস্তায় কাউকে ২০ মিনিটের বেশি প্রহরায় আটকে রাখা যাবে না। অনুরোধ করলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি তাঁর নাম প্রকাশ করবেন। কিন্তু তাঁকে উত্তর দিতে বাধ্য করতে হলে গ্রেপ্তার করতে হবে।

বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানও কার্যত বিচার বিভাগের অজ্ঞাতসারে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার থেকে নির্বাহী বিভাগকে বঞ্চিত করেছে। এটা কোনো আকস্মিক বিধান নয়, অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘(১) গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।

(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’

তবে এখানে লক্ষণীয় হলো, এই বিধান প্রযোজ্য হবে না সেই সব ব্যক্তির জন্য যাঁরা নিবর্তনমূলক আটকাদেশ আইনে ধরা পড়বেন। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় ‘ঘটনাস্থল থেকে আটকের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ’ করা হয়েছে। সুতরাং সেই আটক ব্যক্তির বিষয়ে দ্রুত একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দরকার। এ বিষয়ে জানতে জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।


(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আওয়ার নিউজ বিডি আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না)



মন্তব্য চালু নেই