সুযোগ থাকলে অর্থমন্ত্রীকে এই প্রশ্নগুলো করতাম
শাহ এ এম এস কিবরিয়া তখন অর্থমন্ত্রী। সচিবালয়ে তার কক্ষে আমাদের আলোচনাটা একটু দীর্ঘই হয়েছিলো। অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এসে জানালেন, ‘স্যার গভর্নর সাহেবের সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। উনি পথে আছেন।’
কিবরিয়া সাহেব বললেন, ‘আমাদের যে আরো একটু সময় লাগবে।’
‘উনি চলে এলে আমি কি পিএস সাহেবের রুমে উনাকে বসাবো?’ ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানতে চাইলেন।
‘অর্থমন্ত্রীর অফিসে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অপেক্ষা করবেন – এটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া উনার সঙ্গে যখনই কোনো মিটিং থাকে, উনি সোজা এসে আমার রুমেই ঢোকেন। সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের তো এটাই প্রটোকল,’ কিবরিয়া সাহেব বললেন।
ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
ঢাকার মিডিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা লোপাট হওয়া নিয়ে বর্তমান অর্থমন্ত্রী এ এম এম মুহিতের কথাবার্তা পড়তে পড়তে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতিটুকু মনে পড়ে গেলো।
টাকা লোপাট হওয়া নিয়ে অর্থমন্ত্রী বেশ উত্তেজিত হয়ে আছেন। উত্তেজনাটা তার ঠিক কী নিয়ে সেটা অবশ্য পরিস্কার নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউরের উপর যে তিনি ক্ষুব্ধ, সেটা কোনোভাবেই আড়াল করা যায়নি। সেই রাগ প্রকাশ করতে গিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের যে প্রটোকল থাকতে পারে, সেটাও ভুলে গেছেন।
জানি, আপনারা হয়তো বলবেন, এতো বড় ঘটনা আতিউর সাহেব গোপন করে রেখেছেন…। সেটা আমার বিবেচনায়ও আছে। সেটা নিয়ে ড. আতিউরের উপর পুরো দেশবাসীই বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কাজ ক্ষুব্ধ হওয়া নয়, তাদের কাজ পদক্ষেপ নেয়া। অর্থমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন, এবং সেই উত্তেজনাটা তার বক্তব্যে, তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজে’ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে।
আরো একটা কথা, দেশের অর্থমন্ত্রীকে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের যে প্রটোকলকে’ সম্মান জানাতে হয়, সেটা তিনি করছেন না।
তবুও অর্থমন্ত্রীর উত্তেজনাকে আমি স্বাগত জানাই। এ নিয়ে কথা বলার আগে কয়েকটি বিষয়ে একটু আলোকপাত করে নিতে চাই। টাকা লোপাটের ঘটনায় অর্থমন্ত্রী সুস্থির কোনো অবস্থান নিতে পারেননি। ‘আমিও আপনাদের মতো পত্রিকায় পড়ে জেনেছি’ – মিডিয়াকে এমন বক্তব্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী শুরুতেই গুঞ্জনকেই উসকে দিয়েছেন।
দেশের রিজার্ভের অর্থ লোপাট হয়েছে – মিডিয়ায় এমন একটি খবর পড়ার পর অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার খোঁজখবর নিয়ে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করা উচিৎ ছিলো। সেটি না করতে পারলে, মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। ‘আমাকে জানানো হয়নি, পত্রিকা পড়ে জেনেছি’ – অর্থমন্ত্রীর এই পাবলিক স্টেটমেন্ট বেশ কিছু গুঞ্জনের সৃষ্টি করেছে। কেননা অর্থমন্ত্রী সরকারের দায়িত্বশীল অংশ। অর্থ লোপাটে যে ক্ষতি হয়েছে, তার সঙ্গে সরকারকে জড়িয়ে গুঞ্জন তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করে সেই ক্ষতিটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
পরদিনই তিনি আবার মিডিয়াকে জানিয়ে দিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায় নেই। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করবে।’ এই বক্তব্যটাও সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। বিনা তদন্তে, খোঁজখবর নিয়ে সরকারের অর্থমন্ত্রী যখন দায়মুক্তি দেন, তখনো কিন্তু নানা গুঞ্জন তৈরি হয়, এই ক্ষেত্রেও হয়েছে। আর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরির আশংকা তৈরি করেছেন তিনি।
গত কয়েকদিন ধরে তো মনেই হয়েছে- অর্থ মন্ত্রণালয় আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী যেভাবে ‘আতিউর আতিউর’ করছিলেন, সেটা অশোভন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো।
তবু অর্থমন্ত্রীর এই ক্ষোভ, উত্তেজনাকে আমি স্বাগত জানাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপরাধীর বিরুদ্ধে দেশের অর্থমন্ত্রী উত্তেজনায় কেঁপে উঠবেন- তার চেয়ে আশার কথা আর কী-ই বা হতে পারে? আমরা আশা করবো, তার এই উত্তেজনা লোপাট হওয়া টাকা উদ্ধার এবং লোপাটকারীদের আইনের মুখোমুখি করার ব্যাপারে সহায়তা করবে।
তারপরও অর্থমন্ত্রীকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। ‘মাত্র’ ৮০০ কোটি টাকা লোপাট হওয়ায় তার যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সেই উত্তেজনা ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা সৃষ্টি করতে পারেনি কেনো? বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনায় তিনি যেভাবে ‘আতিউর আতিউর’ করে ছুটোছুটি করছেন, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ডেস্টিনি নিয়ে তাকে এভাবে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়নি কেনো? বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আর্জি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছুটে যাননি কেনো? শেয়ারবাজারের প্রসঙ্গটা এখানে না হয় না-ই আনলাম।
সুযোগ থাকলে অর্থমন্ত্রীকে এই প্রশ্নগুলো আমি করতাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। আওয়ার নিউজ বিডি এবং আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
মন্তব্য চালু নেই