গ্রেফতার অস্বীকার, আগেই বিদেশ পাড়ি নাকি আত্মগোপনে? নানা প্রশ্ন

সালাহ উদ্দিন আসলে কোথায় ?

‘হ্যালো… হ্যাঁ আমি। সম্ভবত বাসায় কেউ ঢুকেছে। বুঝতে পারছি না কিছু। ঘরে ঢুকে পড়েছে ওরা!’ মোবাইল ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে চার লাইনের এই কথাটি ছিল নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের শেষ কথা। ১০ মার্চ মঙ্গলবার রাত ঠিক ১০টা ১০ মিনিটে কথা বলার সময় মোবাইল ফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন। উত্তরার একটি বাসা থেকে একই সঙ্গে নিখোঁজ হন তার একজন ব্যক্তিগত সহকারী ও গৃহকর্মী। স্বামীর খোঁজে স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ধরনা দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কাছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফ কথা, সালাহউদ্দিন আহমেদের খোঁজ তাদের কাছে নেই।

প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, সরকারি কোনো বাহিনী সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতার করেনি। তবে তাকে খোঁজা হচ্ছে, পেলে গ্রেফতার করা হবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ আগেও আত্মগোপনে ছিলেন, এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন।
থানা, ডিবি, এসবি, সিআইডি কিংবা র‌্যাব- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংস্থার কাছেই সালাহউদ্দিন আহমেদের খোঁজ না পাওয়ায় অজানা আশঙ্কা এখন সালাহউদ্দিনের পরিবারে। একে একে সাত দিন পেরিয়ে যাওয়ায় তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ স্বামীর জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। উদ্বিগ্ন হাসিনা আহমেদ মঙ্গলবার রাতে দেখা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।

সালাহউদ্দিনের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে বলেন, আমার একটাই আবেদন- আব্বুকে সুস্থ অবস্থায় যেন ফেরত দেওয়া হয়। এটাই আমার চাওয়া।নিখোঁজের সাত দিন পরও সালাহউদ্দিন আহমেদসহ তিনজনের সন্ধান না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে নানা প্রশ্ন- সালাহউদ্দিন প্রকৃত অর্থেই এখন কোথায়। তারা বলছেন, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না সালাহউদ্দিনকে। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে বলতে পারছেন না কেউ। আসলে তিনি এখন কোথায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, সালাহউদ্দিনের খোঁজ পেতে অভিযান চলছে। সালাহউদ্দিনকে গত সপ্তাহে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বলে তার পরিবার ও বিএনপির অভিযোগ। এর আগেও সালাহউদ্দিনের খোঁজে গুলশানে পুলিশ ও গোয়েন্দারা অভিযান চালায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত মাসে গুলশানে একজন ব্যবসায়ীর বাসায় পুলিশ হানা দিলেও তার খোঁজ পায়নি। তখন ওই বাসা থেকে পুলিশ কেয়ারটেকারকে ধরে নিয়ে যায়। যদিও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার উত্তরার একটি বাসা থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যায় সালাহউদ্দিনকে।

অজানা আশঙ্কা : বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের খোঁজ না পাওয়ায় উদ্বিগ্ন তার পরিবার। সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, আমার একটিই চাওয়া, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে, সেরকম সুস্থ অবস্থায় তাকে আদালতে হাজির করা হোক- এটাই আমার আবেদন।

আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তিনি যেন আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ নির্দেশ দেন। আমার ছেলেমেয়েকে আশ্বস্ত করুন, আমার স্বামী সুস্থ ও ভালো আছেন। এ সময়ে মায়ের পাশে বসা ছোট ছেলে সৈয়দ ইউসুফ আহমেদ ও মেয়ে রাইদাও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। হাসিনা বলেন, বিদেশে থাকা আমার বড় ছেলে এবং মেয়েও কিছুক্ষণ পরপর টেলিফোন করে বাবার সন্ধান জানতে চায়। আমি কিছুই বলতে পারি না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিনের বড় ছেলে সৈয়দ ইব্রাহিম আহমেদ কানাডায় এবং বড় মেয়ে পারমিজ আহমেদ ইকরা মালয়েশিয়াতে পড়াশোনা করছেন।

পুলিশের প্রতিবেদন : যে বাসা থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে ‘তুলে নেওয়ার’ অভিযোগ করেছে পরিবার, সেখানে খুঁজে এসে রায়হান নামে এক ব্যক্তির অবস্থান ও চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলামের তদন্তের এই তথ্য রবিবার বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চে উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র‌্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া পাঁচটি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। কোথাও তার খোঁজও পাওয়া যায়নি। হাসিনা আহমেদের অভিযোগ, ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আগে ফোন করে তাকে বিষয়টি জানানোরও চেষ্টা করেন তিনি। স্বামীর খোঁজ চেয়ে পরদিন রাতে গুলশান থানা ও উত্তরা থানায় জিডি করতে চাইলেও পুলিশ তা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন হাসিনা। পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরার তিন তলা যে বাড়ি থেকে সালাহউদ্দিন নিখোঁজ হয়েছিলেন বলা হচ্ছে, তার মালিক মৃত ড. সিরাজ উদ দৌলা। তার মেয়ের পক্ষে রেজা নামের এক ব্যক্তি ওই বাসার দেখভাল করেন।

ওই বাড়ির নিচতলায় পশ্চিম পাশে গ্যারেজ, পূর্ব পাশ ব্যবহার করা হয় গুদাম হিসেবে। দুই দারোয়ান আশরাফুল ও আকতার নিচতলাতেই থাকেন।দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার চারটি ফ্ল্যাটে চারটি পরিবার বসবাস করে, যার মধ্যে দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটটি পুলিশের অনুসন্ধানের সময় তালাবদ্ধ ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ডিএমডি হাবিব হাসনাত ও তার স্ত্রী সুমনা ওই বাসার ভাড়াটিয়া। ‘জিজ্ঞাসাবাদে দারোয়ান আকতার জানান, চার দিন আগে হাসনাত সাহেব সস্ত্রীক বাসা থেকে গেছেন। যাওয়ার সময় রায়হান নামে একজন মেহমানকে রেখে যান। হাসনাত সাহেব দারোয়ানদের বলে যান, তাদের অনুপস্থিতিতে মেহমান বাসায় থাকবেন।’ আকতার আরও জানান, বাসায় রাত ১১টা পর্যন্ত ভাড়াটিয়ারা গাড়ি নিয়ে যাওয়া-আসা করেন। ১০ মার্চ আনুমানিক ৯টার দিকে ৪-৫ জন মেহমান হাসনাত সাহেবের বাসায় আসেন। নক করার পর দরজা খুললে তারা ভিতরে ঢোকেন। আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর বাসায় আসা লোকদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে যান সেই মেহমান। ওই লোকটি সালাহউদ্দিন কিনা, সেটা তারা (দারোয়ান) জানেন না।

আদালতে রিট আবেদন করার পর সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা শিওর, বাসার দারোয়ানকে উনারা ডিবির কার্ড দেখিয়ে বলেছে আমরা ডিবির লোক। ছয় গাড়ি লোক গিয়ে চোখ ও হাত বেঁধে তাকে (সালাহউদ্দিন) নিয়ে যায়।’ তবে দারোয়ানের বরাত দিয়ে পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রায়হান নামের ওই ব্যক্তির কাছে যারা এসেছিলেন, তাদের পরনে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক ছিল না। কোনো অস্ত্রও দারোয়ানরা দেখতে পাননি। বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়ি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলে মনে হয়নি। মেহমানের হাতে হাতকড়া ছিল না। তাকে জোর করে নেওয়া হচ্ছে বলেও মনে হয়নি। ওই বাড়ি থেকে কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্যও ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া যায়নি বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ। হাবিব হাসনাত সাহেব বাসায় মেহমান রেখে কোথায় গেছেন, তাও তারা জানেন না। তবে দুই দিন ধরে তাদের গাড়িগুলো গ্যারেজে নেই। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পেরেছে, হাবিব হাসনাত ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছেন। তার স্ত্রী সুমনা বাবার বাড়িতে যাননি। হাসনাত ও সুমনার সন্তানরা তাদের সঙ্গে থাকেন না। তাদের মোবাইল দুটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ অবস্থায় কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, আলোচ্য বাসায় সালাহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বা তাকে কেউ গ্রেফতার বা অপহরণ করেছে। সব প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের সামনে তিনটি পয়েন্ট বলেন। এগুলো হলো- ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন হাসিনা আহমেদ পুলিশের কাছে যাননি? জিডি করতে গিয়ে তিনি ‘লিখিত দিতে’ কেন অস্বীকার করেছেন? স্বামীর অপহরণের কথা জানাতে থানায় তিনি ‘সাংবাদিকদের নিয়ে’ গেলেন কেন?এসব ব্যাপারে হাসিনা আহমেদ গত রাতে বলেন, তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্যই ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছেন। ওই সময়ের মধ্যে তিনি বাসার দারোয়ান আকতারের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু জেনেছেন। সালাহউদ্দিনের আশ্রয়দাতা ব্যাংক কর্মকর্তা হাসনাতের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তারা দুবাই গেছেন। এ জন্য একটু দেরি হয় পুলিশকে জানাতে।

সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে : স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ আগেও আত্মগোপনে ছিলেন, এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কৃষি ইনস্টিটিউটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ এর আগেও আত্মগোপনে থেকে বিভিন্ন সময় তালেবানি পদ্ধতিতে সংবাদ মাধ্যমে বার্তা পাঠাতেন। আমরা আগেও তাকে খুঁজছিলাম, এখন গোয়েন্দা পুলিশ তাকে খুঁজছে।বাংলাদেশ প্রতিদিন



মন্তব্য চালু নেই