সালাহ উদ্দিনের সন্ধান : রাজনৈতিক সমঝোতা !
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়াটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমাঝোতার ধারাবাহিক অংশ বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে দেশের গুমোট পরিস্থিতির একটি স্থায়ী সমাধানেরও দাবি জানান তারা।
তবে দীর্ঘ ৬৩ দিন ‘নিখোঁজ’ থাকার পর বিএনপির মধ্যম সারির এই নেতার সন্ধান পাওয়াকে বিএনপির অন্তরালের রাজনীতি হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের মতে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সালাহ উদ্দিনের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছিল বিএনপি। একই সঙ্গে বিষয়টিকে পুঁজি করে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে যেতে চেয়েছে তারা।
অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, সালাহ উদ্দিন দেশে না ফেরা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে বা সরকারের কোন সংস্থা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তবে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না বলে সালাহ উদ্দিনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে- এমনটিও অমূলক নয়।
সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো ধরনের সমঝোতার বিষয়টিও স্বীকার করছেন না দলটির নেতারা।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়াটা শুধুমাত্র তার পরিবারের জন্য নয়, দেশ ও জাতির জন্য সুখবর। কারণ গণতান্ত্রিক একটি দেশে এভাবে শুধুমাত্র কোনো রাজনীতিক নয়, যে কোনো নাগরিকের নিখোঁজ হওয়া শুভ নয়। এতে আইনের শাসন বিতর্কিত হয়।’
বদিউল আলম বলেন, ‘সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়া ও সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি এখন নতুন মোড় নিল। তবে যেহেতু তিনি জীবিত, তাই যত দ্রুত সম্ভব তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিষয়টির অনুসন্ধান করা উচিত। সালাহ উদ্দিনের সন্ধান পাওয়াটা দুটি অর্থ বহন করে। এক. দেশের নোংরা রাজনীতির অংশ হিসেবে প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপির কোনো অপরাজনৈতিক চর্চার অংশ। দুই. হতে পারে সরকারই কোনো সংস্থার মাধ্যমে তাকে তুলে নিয়ে পরে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ফিরিয়ে দিয়েছে।’
বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার অংশ হিসেবে সালাহ উদ্দিনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে টানা তিন মাস আমরা দেশের মধ্যে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছি তা তিন সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে স্থির হতে শুরু করে। পরে দেখা যায়, নিজের কার্যালয় ছেড়ে বিএনপি চেয়ারপারসন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন, জামিন পেয়ে বাসায় ফিরেছেন। সিটি নির্বাচনে তিনি দলের সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণাও করেছেন। এর পর দেখা গেল সিটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে বিএনপি তা বয়কট করলেও বড় ধরনের কোনো আন্দোলনে যায়নি। এগুলো রাজনৈতিক সমঝোতার ইঙ্গিত দেয়। অবশ্যই এ ধরনের কিছু হয়ে থাকলে তা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। বিএনপি ও সরকারের মুখোমুখি অবস্থানের সময় সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তখন সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। এখন যদি সরকার ও বিএনপির মধ্যে কোনো গোপন সমঝোতা হয়, তাতে ক্ষতি কী?’
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমি সব সময় বলি সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। এখানে সবকিছুই ঘটতে পারে। সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়াটাও এমন একটি বিষয়। যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ সালাহ উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকায় তার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। অনেকে হয়তো ভেবেছিল সালাহ উদ্দিন আহমেদ গুম হয়ে গেছেন। ঠিক ওই মুহূর্তে তার সন্ধান পাওয়া দেশের রাজনীতির জন্য পজেটিভ একটি বিষয়। আমরা কখনই চাই না দেশে বিচারবহির্ভূত কিছু ঘটুক। তবে এখন সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়াটা রাজনীতিতে নতুন মাত্রা আনতে পারে। সেটা হতে পারে ইতিবাচক আবার হতে পারে নেতিবাচক। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সরকার ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টিও অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। এমনটিও হতে পারে গোপন কোনো সমঝোতা হয়ে থাকলে সেটা তো গোপনই। শুধুমাত্র অনুমান করা সম্ভব। প্রকাশ হয়ে গেলে তো আর গোপন থাকে না। তাই গোপন সমঝোতার বিষয়ে যে অনুমান করা হচ্ছে সে বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমঝোতার বিকল্প শুধুই সমঝোতা।’
সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজের বিষয়টিকে বিএনপির অন্তরালের রাজনীতি হিসেবে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘অন্তরালের রাজনীতি কখনো সমান্তরালে চলতে পারে না। অন্তরালের রাজনীতি সব সময় অন্তর্ধানে রূপ নেয়। এক্ষেত্রে সালাহ উদ্দিন ভাগ্যবান। কারণ তিনি জীবিত আছেন। বিএনপি অন্তরালের রাজনীতির মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল। সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ ইস্যুকে পুঁজি করে সরকার উৎখাতের রাজনীতি করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে হয়তো এখন সালাহ উদ্দিনকে প্রত্যাবর্তন করাতে বাধ্য হয়েছে।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘যেহেতু সালাহ উদ্দিনকে জীবিতে পাওয়া গেছে তাই এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। এখন সরকারের উচিত এই গভীর রহস্যটি গভীর থেকে অনুসন্ধান করে উদ্ঘাটন করা। রহস্য উন্মোচন সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন সাহেবকে জীবিত পাওয়া গেছে এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমরা দলের পক্ষ থেকে সত্যি আনন্দিত তার জীবিত সন্ধানের খবর পেয়ে। তবে এই মুহূর্তে সালাহ উদ্দিন সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। উনি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমাদের দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে তাকে সরকারের কোনো বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ দলের চেয়ারপারসনও দাবি করেছেন সালাহ উদ্দিন সাহেবকে র্যাব তুলে নিয়ে গেছে। একই সঙ্গে দল সালাহ উদ্দিন সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার ইস্যুতে আন্দোলনের পরিকল্পনাও করছিল। ঠিক এই মুহূর্তে তার সন্ধান পাওয়া কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি করে।’
রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘হতে পারে সরকার বাধ্য হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। তবে সালাহ উদ্দিন সাহেব দেশে ফেরার পর এ সব বিষয়ে তার মুখ থেকে শোনা উচিত।’
সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন সাহেবের নিখোঁজের বিষয়টি যদি বিএনপির অন্তরালের রাজনীতি হয়ে থাকে তবে তার প্রমাণ সরকারকে করতে হবে। সালাহ উদ্দিন সাহেবকে পাশের দেশের একটি অঙ্গরাজ্যে পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া তিনি কীভাবে ভারতে প্রবেশ করলেন। এ বিষয়ে তো ভারতের কর্তৃপক্ষও তদন্ত করবে। সরকারের উচিত হবে কোনো অভিযোগ করার আগে প্রমাণ করা তাদের কোনো হাত নেই সালাহ উদ্দিন সাহেব নিখোঁজের পেছনে।’
সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো গোপন সমঝোতা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি দলের যে পর্যায়ে আছি এখানে থেকে যতটুকু জানি কোনো ধরনের সমঝোতা সরকারের সঙ্গে হয়নি। বিএনপি এই অবৈধ সরকারের সঙ্গে কোনো বিষয়ে সমঝোতা করবে না।’ দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই