সামুদ্রিক পাখি ফ্রিগেট বার্ড
একটি অদ্ভুত সামুদ্রিক পাখির নাম ফ্রিগেট বার্ড। শুধু অদ্ভুত বললে সম্ভব তাদের ব্যাপারে অন্যায় করা হবে। এদের জীবনাচরণ অনন্য রহস্যে ভরপুর। নানা রকমের ব্যতিক্রম আর অনন্য আচরণের কারণে সাধারণ যে কোনো পাখির সাথে এর তুলনা করাও সঙ্গত হবে না। পৃথিবীতে ফ্রিগেটের পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে দু’টি প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে একটি প্রজাতির নাম ম্যাগনিফিসেন্ট ফ্রিগেট বার্ড। তিন ফুটের চেয়ে লম্বা পাখিটির পাখাদ্বয়ের দৈর্ঘ্য সাত ফুটের ওপরে। পুরুষ আর নারী পাখির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।
পুরুষের গলাটি একটি ফুলানো বেলুনের মতো। এর রঙ টকটকে লাল। বয়োপ্রাপ্ত হলে এর ঔজ্জ্বল্য আরো বাড়ে। পালক কালো। গলার দিকে এটি রঙধনুর মতো। সূর্যের আলো পড়ে গলা রক্তবর্ণ ধারণ করে। গলার নিচের অংশ সাদা। পাখায় বাদামি রঙের ব্যান্ড। চোখে যেন নীল একটি বৃত্তের মাঝে টলমল করছে। বাচ্চা পাখির রঙ ভিন্ন। এদের শরীরের নিচের অংশটা সাদা। ক্যারিবিয়ান সাগর, প্রশান্ত মহাসাগর আটলান্টিক মহাসাগরের আমেরিকার উপকূলজুড়ে এদের বসবাস। অন্য উল্লেখযোগ্য প্রজাতিটি হলো গ্রেট ফ্রিগেট বার্ড। দেখে দুটো পাখিকে একই জাতি গোত্রের মনে হলেও উভয়ের মাঝে পার্থক্যগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। এদের বাস প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল আর ভারত মহাসাগরে।
ফ্রিগেট এরা নিশ্চুপ উড়ে যায়। নীড়ে অবস্থানের সময় এরা নানা ধরনের শব্দ করে। এরা প্রধানত মাছ খেয়ে বাঁচে। অদ্ভুত ব্যাপার! সামুদ্রিক পাখি হলেও এরা কখনো পানিতে নামে না। উড়ন্ত অবস্থায় লাফিয়ে ওঠা মাছ শিকার করে। এ ছাড়া অন্য পাখির খাবার কেড়ে খায়। এদের পা খুব ছোট। অন্যান্য সামুদ্রিক পাখির মতো এদের পায়ের পাতা জালের মতো ছড়ানো নয়। ফ্রিগেটের পালক ওয়াটারপ্রুফ নয়। পাখিটির গলার নিচের অংশটা বেশ বড়। ছোট পা দু’টি মাটি স্পর্শ করার আগে গলার অংশটি ভূমিতে বাধা খায়। এ জন্য তারা ভূমিতে ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না।
যেখানটায় ফ্রিগেটের বাসা ঠিক উড়ে গিয়ে সে জায়গার মাটিতে স্পর্শ করে তারা। কারণ তাদের হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা প্রায় নেই। যদি বাচ্চা জন্মদান এবং লালন-পালনের কোনো প্রয়োজন না থাকত তাহলে সম্ভবত এরা বাসাও বাঁধত না। প্রজন্ম রক্ষায় এরা বাসা বাঁধে ও মাটিতে নামে। পাখিবিশারদদের অভিমত হলো যদি সম্ভব হতো তাহলে আকাশে এরা বাসা বানাতো। এদের বাস সমুদ্রের পানির ওপর। এরা মহা সমুদ্রের ওপর আকাশে উড়ে বেড়ায় জীবনের বেশিরভাগ সময়। অকাশটাই তাদের ঠিকানা।
ফ্রিগেট বার্ড সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব নিদর্শন। সামুদ্রিক পাখি কিন্তু অবিশ্বাস্য হলো এরা সাঁতরাতে পারে না। বিজ্ঞানীরা বলেন দেহ কাঠামোয় অসামঞ্জস্যতার জন্যই ফ্রিগেট বার্ড সাঁতরাতে এমনকি পানিতে নামতে পারে না। সমুদ্রকেন্দ্রিক এ পাখিটির জীবনাচরণ আরো অনেক বৈপরীত্য ও রহস্যময় আচরণ দেখা যায়। কেবল অল্লাহপাকই জানেন এ পাখিটির এ অনন্য বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণ কী? স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। পুরুষ পাখিগুলো বড়ই অদ্ভুত। গলার নিচে বিরাট থলে। টান টান এ বর্ণিল বেলুনের দ্বারা তারা স্ত্রী পাখিদের আকর্ষণ করে।
পুরুষ পাখিরা দল বেঁধে গলার বেলুনসদৃশ বর্ণিল অংশটি নাচিয়ে প্রদর্শনী দেয়। এমনকি নাচানাচি করতে থাকে। খুব নিচু দিয়ে একসাথে দল বেঁধে উড়ে যায়। এ সময় মাথা নাড়ায় এবং তালে তালে পাখা ঝাঁকায়। প্রদর্শনী পছন্দ হলে স্ত্রী পাখি তার পছন্দনীয় পুরুষ পাখিটির পাশে এসে বসে। শরীর নেড়েচেড়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। জোড় বাঁধার জন্য পুরুষ পাখিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নানা ধরনের চেষ্টা চালায় জোড় সংগ্রহে। এরই অংশ হিসেবে তারা দল বেঁধে এ ধরনের প্রদর্শনী করে। এ সময় সব পাখি সাফল্য পায় না। তবে অনেকেই তাদের কাক্সিত জোড়টি সংগ্রহ করতে পারে।
পাখি মানেই উড়তে পারে কিন্তু এদের ক্ষেত্রে তা একটু ভিন্ন। এরা উড়তে অত্যন্ত দক্ষ। পাখার বিস্তারের তুলনায় পাখির ওজন অত্যন্ত নগণ্য। পাখার বিস্তার সাত ফুটের ওপরে হলেও পাখিটির ওজন মাঝারি আকারের ঘুঘুর মতো। তা কোনো রকমেই দেড় অথবা পৌনে দুই কেজির ওপরে নয়। যা অবিশ্বাস্য। এদের হাড়ের ওজন শরীরে মোট ওজনের ৫ শতাংশ মাত্র। এরপর পাখার জোর বিস্ময়কর। তারা শূন্য আকাশে পাখার শক্তি আর ক্ষীপ্রতা দিয়ে পরাস্ত করে অন্য পাখিদের। ভয়ে অন্যান্য পাখি তাদের কাছে ভিড়তে চায় না। আকাশে এরা অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমন পানিতে একটি মাছ। বড় পাখা তাদের জন্য কোনো বাধা নয়। যেকোনো সময় যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। সমুদ্রের ওপরে মাছ লাফিয়ে উঠে অত্যন্ত ক্ষীপ্রতার সাথে সেগুলোকে এরা নিজেদের শিকার বানাতে পারে। এ জন্য এরা সমুদ্রের ওপরে অন্য পাখিদের থোড়াই কেয়ার করে। পাখি যত বড় এবং শক্তিশালী হোক মুহূর্তেই তার ওপর হামলে পড়ে। খাবার কেড়ে নেয়।
মহাসমুদ্রের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া এদের উপযোগী এলাকা। তারা খুব সহজে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। এমনকি কোনো ধরনের প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে আকাশে এরা ভেসে থাকে দীর্ঘ সময়। খুব কম পাখিরই এ ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। একবারের মতো ভ্রমণে এরা মহাসাগর পাড়ি দেয়। এ দূরত্ব কখনো আট হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। অর্থাৎ বাসা থেকে একবারে এরা এ দূরত্ব পাড়ি দেয়।
বিজ্ঞানীরা এখনো এদের ব্যাপারে অসংখ্য প্রশ্নেরই উত্তর জানেন না। প্রতিনিয়ত এদের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বেড়েই চলেছে। এদের সবচেয়ে বড় কলোনিটি দেখতে পাওয়া যায় সিসিলি দ্বীপে। এখানে দশ হাজার জোড়া ফ্রিগেটের বসবাস। দ্বীপটিতে এদের জীবনাচরণ নিয়ে গবেষণা কাজ চলছে। ভূউপগ্রহ থেকে এদের প্রাত্যহিক জীবনের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
নিচু এলাকায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে এরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়া এবং বাচ্চা লালন-পালনে এরা অত্যন্ত আন্তরিক। পুরুষ ও মা পাখি উভয়ে ভাগাভাগি করে দায়িত্ব পালন করে। ডিমে তা দেয়ার সময় বারো দিনের জন্য জোড়ের একটি পাখি বাইরে যায়। আবার ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে তিন দিনের জন্য পালা করে করে বাইরে যায়। এ সময়গুলোতে এরা সর্বোচ্চ চার হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দেয়। একটি মাত্র ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফোটার প্রথম তিন মাস স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দু’জনে মিলে যতœ নেয়। খাবার সংস্থান করে। কিন্তু এরপরের আট মাস স্ত্রী পাখি একাই বাচ্চার কেয়ার করে। প্রতি বছরই ফ্রিগেট ডিম পাড়ে না। বাচ্চা পাখিরা দীর্ঘ সময় প্রখর রোদে পড়ে থাকে। দেখলে মনে হতে পারে পাখি ছানাটি মৃত। কিন্তু মা পাখি যখন খাবার নিয়ে আসে তখনি এরা জেগে ওঠে। মায়ের মুখের ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা খাদ্য গ্রহণ করে।
রোদের মধ্যে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকার মধ্য দিয়ে এদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এরা প্রায় দশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যায়। কোনো পাখি এর চেয়ে বেশি ওপর দিয়ে ওড়ে না। বয়োপ্রাপ্ত হতে এরা বেশ সময় নেয়। ফ্রিগেট পূর্ণতা পেতে দশ থেকে বারো বছর সময় নেয়। গর্ভধারণ, ডিম পাড়া ও ডিম ফুটে বাচ্চা উৎপাদনে অনেক সময় নেয়। এ সময়টা প্রায় এক বছর। পাখিদের মধ্যে জন্মদান প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি সময়ের রেকর্ডও এটি। এরা দীর্ঘজীবী পাখি। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর অথবা আরো বেশি দিন বাঁচে এরা।
মন্তব্য চালু নেই