সামরিক ফরমানের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে মানুষ

১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ছিল রোববার। অন্যদিকে এদিন ছিল অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সপ্তম দিবস। আগের দিন সামরিক সরকারের জারি করা ১১৫ নং সামরিক ফরমানের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে।

অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিক এমপ্লয়িজ অব পাকিস্তানের সমন্বয় কাউন্সিলের সভায় বক্তারা অবিলম্বে এ আইন বাতিলের দাবি জানান। এরপর তাঁরা এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে চলমান অসহযোগের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং অফিস বর্জনের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।

এদিকে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় এবং জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু আহূত অহিংস-অসহযোগের এদিনটিও সাফল্যজনকভাবে শেষ হয়। রাজধানী ঢাকা নগরীসহ এদিন সারাদেশ ছিল উত্তাল ।

১৪ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান। অপরদিকে ন্যাপ নেতার সঙ্গে ছিলেন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক গাউস বক্স বেজেঞ্জো।

আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাংলার জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিপিপাসু গণমানুষকে পৃথিবীর কোন শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

এদিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে তিনি সর্বসাধারণের উদ্দেশে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ ঐক্যবদ্ধ আপামর জনগণ সামরিক আইনের নিকট নতি স্বীকার না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কাজেই যাদের প্রতি সামরিক আইনের সর্বশেষ আদেশ দেয়া হয়েছে তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেন কোনপ্রকার হুমকির মুখে মাথা নত না করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়। কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। এবং প্রয়োজনবোধে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুক্তির লক্ষ্যে পদার্পণ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম আরও পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত থাকবে। আমি যে কোন আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকার এবং কোনপ্রকার শক্তি প্রয়োগ করলে তা সম্ভাব্য সকল উপায়ে প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই।’

এই বিবৃতির সঙ্গে জারি করা হয় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নয়া নির্দেশ, যা ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ৩৫নং নির্দেশনামা বলে বিবেচিত। নয়া এই নির্দেশের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সকল নির্দেশ ও তার ব্যাখ্যাসমূহ এ নির্দেশের অংশ বলে গণ্য হবে এবং এই নির্দেশ আগামীকাল অর্থাৎ ১৫ মার্চ সোমবার হতে কার্যকর হবে।

বাংলাদেশের জনগণের নামে প্রদত্ত নির্দেশে বলা হয়, বাংলাদেশের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেক্রেটারিয়েট ও দফতরসমূহ, আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য আদালতে হরতাল বর্ণিত নির্দেশানুসারে পালিত হবে।

বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ডিসি এবং মহকুমা প্রশাসকগণ অফিস বন্ধ রেখে স্ব-স্ব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে কাজ করবে। প্রয়োজন হলে উন্নয়নমূলক কাজসহ অন্যান্য কাজও করবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে সহযোগিতা করবে। পুলিশ বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে, প্রয়োজনানুযায়ী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করবে।

এদিকে এ দিনে করাচীর নিসতার পার্কে এক জনসভায় ভুট্টো ‘এক পাকিস্তান এবং দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা’ এরূপ একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে বলেন, ‘যে কোন ধরনের সাংবিধানিক নিষ্পত্তির পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মতে, যদি জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তবে এটি অবশ্যই হতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও অনুরূপভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে।’



মন্তব্য চালু নেই