সাতক্ষীরায় খোশমেজাজে আওয়ামী লীগ, সঙ্কটে বিএনপি-জামায়াত

অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পুলিশী হয়রানির মুখে রাজনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে সাতক্ষীরায় বিএনপি-জামায়াত। অন্যদিকে রাজপথে খোশমেজাজে আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমনটাই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

বিএনপি-জামায়াত নেতাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশের বাধার মুখে তারা রাজপথে নামতে পারছেন না। রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে এলে অবশ্যই তারা মাঠের আন্দোলনে সরব হবেন।

তবে ওই দুই দলের অভিযোগ সরাসরি নাকচ করেছে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ। আওয়ামী লীগের দাবি, তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে রাজপথে নামতে কোনো বাধা দিচ্ছে না।

পুলিশও আওয়ামী লীগের সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, বিএনপি-জামায়াতের কোনো নেতাকর্মীকে হয়রানি বা গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তবে যারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

রাজনৈতিকবোদ্ধারা মনে করেন, দীর্ঘ ১০ বছর পর সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা হওয়ায় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এখন রয়েছে খোশমেজাজে। তাই কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে রাজপথে দেখা যাচ্ছে তাদের। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমান কমিটির সভাপতি মনসুর আহম্মেদ ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কমিটি গঠনের পর নেতাকর্মীরা এখন অনুপ্রাণিত। তারা নতুন করে শক্তি ও সাহস সঞ্চার করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।’

বিরোধী দলকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও বিএনপি-জামায়াতের নেতারা নিজেরা মাঠে থাকেন না। তাদের কোনো কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হয় না।’

কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে বিএনপি-জামায়াতের ক্ষেত্রে। ২০ দলীয় জোট ঘোষিত টানা অবরোধ কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত মাঠে দেখা যায়নি সংগঠন দুটির নেতাকর্মীদের। এমন কি হরতালেও।

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সভাপতি রহমাতুল্লাহ পলাশ জানান, নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে তো আর রাজনীতি করা যায় না। পরিবেশ পেলে কে না রাজনীতির মাঠে থাকতে চায়। সময় হলে অবশ্যই তারা মাঠে থাকবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অথচ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরায় জামায়াত-বিএনপির শক্তি প্রদর্শন ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা সারাদেশ থেকে সাতক্ষীরাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে রাখে— এমনই দাবি রাজনৈতিকবোদ্ধাদের।

এলাকার রাজনীতি সচেতন মানুষ বলছেন, এখন সেই সাতক্ষীরা বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ জায়গা।

অনেকে জানান, পুলিশী তৎপরতায় ২০ দলীয় জোট ঘোষিত হরতাল-অবরোধের কোনো প্রভাব সাতক্ষীরায় পড়েনি। পেট্রোলবোমার ভয়ে এখানকার জনগণকে তটস্থ থাকতে হয় না।

পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির পর জামায়াত-শিবির জেলাজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। এ সময় আওয়ামী লীগের ১৭ জন নেতাকর্মীকে কুপিয়ে, গলাকেটে হত্যা করা হয়।

শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এ দাবি আওয়ামী লীগের।

এই সহিংসতায় জেলায় কমপক্ষে ৫০ জন মানুষ প্রাণ হারায় বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে। এ সব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার শতাধিক মামলা হয়েছে। এমন অবস্থায় বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবের সমন্বয়ে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর অভিযানের পর থেকে পাল্টে যায় সাতক্ষীরার রাজনীতির চিত্র। এরপর বিএনপি-জামায়াত আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পুলিশের নিয়মিত অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। মামলা ও পুলিশী হয়রানির ভয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার নেতাকর্মী বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।

কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪০০ জনের। কিন্তু এখন চারগুণ বন্দী থাকছেন সব সময়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারের (২ এপ্রিল, ২০১৫) হিসেব অনুযায়ী বন্দীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৭৫ জন।

তা ছাড়া গ্রেফতারদের মধ্যে অনেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তার এ নিরবতা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিএনপি নেতা বলেন, তিনি (আব্দুল আলিম) ব্যবসায়ী মানুষ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করছেন। আর সভাপতি রহমাতুল্লাহ পলাশ ঢাকায় থাকেন। ফলে অভিভাবকহীন অবস্থায় রয়েছে আমাদের নেতাকর্মীরা। তাই ইচ্ছা থাকলেও নেতাদের অনুপস্থিতিতে কর্মীরা মাঠে নামতে পারছেন না।

জানা গেছে, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও জেলা মৎস্যজীবী দলের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান বিএনপির দু’গ্রুপের কোন্দলে ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিহত হন। এরপর ওই বছরের ২৭ নভেম্বর আগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিব ও এ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলীকে সভাপতি, সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় রহমাতুল্লাহ পলাশ ও আব্দুল আলিমকে।

দীর্ঘদিন সম্মেলন বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় মূলত নেতাকর্মীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে মাঠে নামছেন না— এমনই অভিযোগ তৃণমূলের কর্মীদের।

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসেনি। তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর ভর করতে হচ্ছে। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না।

২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক এস এম আজিজুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন বাকশালী চরিত্রে আবির্ভূত। তারা বিএনপি-জামায়াত কেবল নয় কোনো রাজনৈতিক দলকে মাঠে নামতে দিচ্ছে না। পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী পক্ষকে দমনপীড়ন করছে। যেটি কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র হতে পারে না।’

তিনি দাবি করেন এ পর্যন্ত তাদের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে। দেড় শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এখনো অনেক নিরীহ লোককে ধরে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের অনেক নেতাকর্মী মামলা-হামলার ভয়ে পলাতক জীবনযাপন করছেন।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর বলেন, ‘পুলিশ রাজনৈতিক দলের কোনো নেতাকর্মীকে হয়রানি বা গ্রেফতার করছে না। যারা সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

কর্মসূচি পালনে পুলিশের বাধা প্রসঙ্গে তিনি জানান, জেলা বিএনপির সভাপতি থাকেন ঢাকায়। সাধারণ সম্পাদক থাকেন নিজের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। তাদের তো পুলিশ কখনো মাঠেই দেখেনি। হয়রানি তো দূরের কথা।

এসপি বলেন, ‘কোনো কর্মসূচিতে পুলিশ হয়রানি করলে তারা আমাদের বিরুদ্ধে দোষ চাপাতে পারতেন।’

কিন্তু নিজেরা মাঠে না থেকে পুলিশের ঘাড়ে দোষ চাপানো ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই