সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী

পৃথিবী নামক এই গ্রহের সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী কোনটি। এই প্রশ্নের উত্তর আসলে চটজলদি যেমন দেয়া সম্ভব নয়, তেমনি সঠিকভাবে বলাও সম্ভব নয় যে যাদের আমরা আদিবাসী বলে সম্বোধন করছি তারা আদৌ আদিবাসী কিনা। তবে গবেষকদের গবেষণা এবং তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ব্রাজিলের ‘আয়োরো’ আদিবাসী গোষ্ঠীকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী।

১৯৬৫ সালের দিকে সর্বপ্রথম এই আদিবাসী গোষ্ঠী সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিকরা বেশ কয়েকবার আমাজানের গহীন বনে আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর গবেষণা করার জন্য যান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই অভিযান ব্যর্থ হয় ব্রিটিশদের। কিন্তু সেসময় ব্রিটিশ আনুগত্য পাওয়া ব্রাজিলের শাসক গোষ্ঠী ১৯৬৯ সালে আমাজানের গহীন জঙ্গলে আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর কয়েক দফায় হামলা চালায়। সেই হামলায় গোষ্ঠীটির কয়েকটি উপদল জঙ্গল ছেড়ে জনারণ্যে চলে আসে। কিন্তু কয়েকটি উপদল তখনও আমাজানে রয়ে যায়, তবে তারা আরও গহীন বনের ভেতর ঢুকে যায়।

১৯৪০ থেকে ৫০ সালের মধ্যে মেনোয়াইত কৃষকরা আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর অঞ্চলে কলোনি স্থাপন করেছিল। যদিও আয়োরো গোষ্ঠীর সদস্যরা খুব সহজেই যে তাদের ভূমি ওই কৃষকদের ছেড়ে দিয়েছিল ব্যাপারটি মোটেও তা নয়, যদিও বর্তমানে লিখিত বইয়ে দেখানো হয় যে, আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা স্বইচ্ছায় মোনোয়াইত কৃষকদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মেনোয়াইত কৃষকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায় আয়োরোরা। যেহেতু জঙ্গল ছিল আয়োরোদের পরিচিত তাই গোপনে হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে কোনো ঘটনাই ছিল না।

শেষমেষ মেনোয়াইত কৃষকরা শরণাপন্ন হয় যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থী কিছু গ্রুপের। এই গ্রুপটি ব্রাজিল থেকে আয়োরো আদিবাসী নেতাদের মাথার দাম ঘোষণা করে। ইতিহাসে যা মূলত ‘ম্যানহান্ট’ হিসেবে পরিচিত। সেসময় অনেক আয়োরো নেতাকে হত্যা করা হয়, কোনো অপরাধ ছাড়াই। ভূমি অধিগ্রহন ছাড়া আয়োরোদের নিয়ন্ত্রনে থাকা খনিগুলোকে দখলও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোপন অধিসন্ধি। প্রায় ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই আগ্রসন ঠেকিয়ে রাখে আয়োরোরা। কিন্তু ২০০৪ সালে এসে সর্বশেষ প্রতিরক্ষাও ধ্বংস হয়ে যায় আয়োরোদের।
03২০১৩ সালে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় আমাজানের বৃক্ষ নিধন নিয়ে। সেই রিপোর্টে আমাজানের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের ক্ষতির বর্ননা দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ম্যারিল্যান্ড বর্নিত ওই অঞ্চলগুলো আদতে ছিল আয়োরোদের নিজস্ব ভূমি। এই রিপোর্টের পর ব্রাজিলের হায়াগার্তে পোরা নামের একটি ফার্ম আয়োরোদের কাছ থেকে প্রায় ৭৮ হাজার হেক্টর জমি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে সেই জমিতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের বহুজাতিক কোম্পানি তাদের শিল্প-কারখানা স্থাপন করে।

তবে যোদ্ধাজাতি আয়োরোদের কয়েকটি উপদল এখনও প্রতিবাদ প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে আমাজানের একটি অংশ থেকে। ধারণা করা হয়, আমাজানের চাকো অঞ্চলে তারা সর্বশেষ প্রতিরোধ বুহ্য রচনা করেছে। সম্প্রতি ব্রাজিলের দিলমা রৌসেফ সরকার আমাজানের উন্নয়ন প্রশ্নে বেশকিছু বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এই অনুমোদনের ফলে আমাজানের বর্তমান আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো আরও হুমকির মুখে পরবে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছে। কিন্তু তাতে থেমে সেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর আগ্রাসন।

আয়োরো গোষ্ঠী মূলত পশুপালক গোষ্ঠী। ‍কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হওয়ায় আমাজানের গহীনে সহজেই বাস করতে পারে তারা। এক একটি আয়োরো পরিবারের নিয়ন্ত্রনে থাকে কমপক্ষে শতাধিক শূকর। নিজের বসবাসের জন্য কাঠ দ্বারা নির্মিত ঘরের পাশেই থাকে শূকরের খোয়ার। এই গোষ্ঠীর সমাজে যখন কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তাকে নিজ চেষ্টায় ঘর তৈরি করতে হয়। ঘর তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই আগামী বর্ষায় তাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর বর্ষার শুরু আগে প্রথম যেদিন পাখি ডাকে সেদিন শুরু হয় আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব ‘আছোঞ্জা’। পুরো একমাস ব্যাপী এই উৎসব চলে। গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্য ওই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নিয়ম কানুন পালন করে এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যার যার ভালো শূকরটিকে বলি দেয়া হয়।



মন্তব্য চালু নেই