সন্তানকে অভিশাপ দিলে ক্ষতি কার হবে?

সন্তারে জন্যে মা পৃথিবীর সবচে’ আপনজন। মায়ের কাছে তার কোলের সন্তানের থেকে প্রিয় কিছু আর নাই। নিজের জীবনকে ত্যাগ করে হলেও মা সব সময় চান তার সন্তান সুস্থ, সবল ও নিরাপদ থাকুক। দরিদ্র ঘরের মাকে দেখা যায়, নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন অবলীলায়। সন্তানের অসুখে রাত জেগে তার শিয়রে বসে মাথায় পানি দিচ্ছেন। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা যুগে যুগে অনেক রূপকথা ও প্রবাদের জন্ম দিয়েছে, দিয়েই চলেছে।

এই সন্তানকেই তিনি প্রায় একটি বছর অসহ্য কষ্টে গর্ভধারণ করেছেন। এরপরে সন্তান যখন পৃথিবীর আলোতে চোখ মেলে তাকিয়েছে, তখন তিনি সব কষ্ট ভুলে গেছেন। তাকে লালন পালন করেছেন প্রতিটি ঘাম, প্রতি ফোটা অশ্রুবিন্দু বিসর্জন দিয়ে।

কিন্তু শৈশবের বালখিল্যতা কিংবা কৈশরের দুরন্তপনায় অনেক সময়ই সেই মা সন্তানের অধৈর্য হয়ে সন্তানের প্রতি অভিশাপ দিয়ে বসেন। আমাদের গ্রাম-অঞ্চলে প্রায়েই দেখা যায়, মা তার দুরন্ত ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘তোর মুখ আমি যেনো আর না দেখি’, ‘তোর কেনো মরণ হয় না’ ইত্যাদি ধরনের নানা অভিশাপ বাক্য। অথচ তিনি নিজেও হয়তো কখনো সচেতনভাবে তেমনটি কামনা করেন না। অনেক সময় দেখা যায়, সত্যি যদি মায়ের অভিশাপের পরে সন্তান তেমন কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন আর মায়ের অনুশোচনার শেষ থাকে না।

প্রতিটি ছোট থেকে বড় বিষয়ের মতো এ বিষয়টিকেও ইসলাম এড়িয়ে যায় নি। এ ব্যাপারেও ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়। ইসলাম কখনো কারো বিরুদ্ধে অভিশাপ দেয়া বা বদ দোয়া করাকে সমর্থন করে না। আপন সন্তান তো বটেই সামান্য জীবজন্তু বা পোকা-মাকড়, এমনকি জড় পদার্থকে অভিশাপ দেয়াও সমর্থন করে না।

হাদিসে আছে, জাবের বিন আব্দুল্লা [রা] বলেন, ‘বাতনে বুওয়াতের সফরে রাসুল [স] মাজদি ইবন ‘আমর জুহানিকে খুঁজছিলেন। উকবা আনসারি তাঁর উটের পাশ দিয়ে চক্কর দিয়ে তাকে থামায়। তারপর তার পিঠে উঠে আবার তাকে চলতে নির্দেশ দেয়। হঠাৎ উটটি একেবারে নিশ্চয় হয়ে গেলো। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। রাসুল [স] একথা শুনে বললেন, কে নিজের উটকে অভিশাপ দিলো ? তিনি বললেন, আমি হে আল্লাহর রাসুল। রাসুল [স] বললেন, ‘তুমি এই উটের পিঠ থেকে নামো। তুমি আমাদের কোনো অভিশপ্তের সঙ্গী করো না। তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করো না।’ (মুসলিম)

হাদিস বিশারদগণ এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, হতে পারে যে সময় বদ দোয়া করা হয়েছে, তা দিনের এমন সময়ে কেো হয়েছে, যখন খারাপ বা ভালো সব দোয়াই কবুল করা হয়। (মিরয়াতুল মাফাতিহ)

নি:সন্দেহে বলা যায়, এই হাদিসটি রাগের মাথায় মানুষের তার পরিবার ও সম্পদের বিরুদ্ধে দোয়া করার নিষিদ্ধতা প্রমাণ করে। তাছাড়া নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে দোয়া করার অর্থ তো নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দোয়া করা। প্রকারন্তরে নিজেকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৫)

অতএব আমাদের মায়েদের ভেবে রাখতে হবে, যদি তারা তাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যে কোনো অভিশাপ দিয়েই ফেলে, হোক সেটা রাগের বশেই, আর সেই বদ দোয়া বা অভিশাপটি এমন মুহূর্তে হয়ে গেলো, যখন আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার প্রতিটি দোয়াই কবুল করে নেন, তখন ব্যাপারটা কেমন হবে ? যদি সত্যিই সন্তান ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কি মা তখন সহ্য করতে পারবে। তাই প্রতিটি মায়ের উচিত, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করা।

মাওলানা মনযূরুল হক
[লেখক পরিচিতি : মাওলানা মনযূরুল হক- বর্তমানে তিনি দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘আল ফাতাহ পাবলিকেশন্সের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগে লেখক ও সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনি একজন হাফেজ, আলেম এবং লেখক-সাংবাদিক। পড়াশুনা করেছেন ঢাকার শীর্ষস্থানীয় কওমি মাদরাসা দারুল উলুম মাদানি নগর, কাকরাইল মাদরাসা ও জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগে। বেশ কয়েকটি মৌলিক ও অনুবাদিত গ্রন্থ রয়েছে তার। আহলে হাদিস সমস্যার সমাধান তার লেখা আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি বই। এছাড়াও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে, ফিলিস্তিনের গল্প সংঙ্কলন আশিক মিন ফিলিস্তিন, শিশুতোষ গল্প এই পৃথিবীর পাতায়, নবিয়ে রহমত, সিরাজাম মুনীরা, খোদার আজব বান্দা এরা সহ আরো বেশ কিছু গ্রন্থ।]



মন্তব্য চালু নেই