সংগ্রাম-সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ৬৮ বছরে আওয়ামী লীগ

সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরব-উজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন।

গত শতাব্দীর মধ্য ভাগে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন প্রগতিবাদী নেতাদের উদ্যোগে আহূত এক কর্মী সম্মেলনে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে বাঙালি জাতির মুক্তির বার্তা নিয়ে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বস্তত; এটিই ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বিরোধী প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগ ছাড়াও, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, তফসিলী ফেডারেশন প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এসব দল পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আঙ্কার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ, মুসলিম লীগের দমননীতি এবং ভয়-ভীতি, সর্বোপরি তৎকালীন উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের সামাজিক, রাজনৈতিক আবেগ, অনুভূতি এবং আশা-আকাক্সক্ষা অনুধাবনে কোন দলই সক্ষম ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিসত্ত্বার স্বাতন্ত্র্যের অস্বীকৃতি বাঙালি জাতিকে এক অভিনব বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দিকপাল নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লীগের দূরত্ব, উদীয়মান তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীদের দ্রোহ ও আত্মত্যাগ পরিস্থিতির ঐতিহাসিক নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। দিক-নির্দেশনা এবং নেতৃত্বহীন অসংগঠিত জনতাকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত করা এবং মুসলিম লীগের বিকল্প গড়ে তোলার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই বাস্তবতা থেকেই উৎসারিত হয় আওয়ামী লীগের মতো একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অপরিহার্যতা।

পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয়- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এ দলটি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধে দলটি নেতৃত্ব দেয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা: স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। জেলখানায় জাতীয় চারনেতাকে হত্যার মাধ্যমে এই সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। পরে শুরু হয় সামরিক শাসন। এ সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে নামে আওয়ামী লীগ। এভাবে সবসময় নানা আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকেছে এ দলটি।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব উদ্যোমে এগিয়ে চলা: ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে নেতাকর্মীরাও আবার নব উদ্যমে সংগঠিত হয়। আবারো শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম।

রাষ্ট্র ক্ষমতা: ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ২০০১ সাল থেকে বিএনপি জোটের নির্যাতন এবং ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর আর এক দফা বিপর্যয় কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হয়ে আবারো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় এই দলটি। ২০০৮ সালে পুনরায় সরকার গঠন করে ‘রূপকল্প ২০২১’-এর আলোকে মধ্যম আয়ের সুখী-সমৃদ্ধশালী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখান এবং ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর আলোকে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

সুদীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়েছে। বার বার কালো থাবায় অনেকেই ছিটকে গেছে, আবার অনেক সুবিধাভোগীরা থেকেছে ক্ষমতার ছায়াতলে। তারপরও সব বিপদে এগিয়ে এসেছে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের তূণমূল কর্মীরা। তাদের অনেকেই আজ অবহেলিত; বড় বড় সুবিধা ভোগীদের কারণে। অবহেলিত খেটে-খাওয়া এসব কর্মীরাই সংকটে, দুর্যোগে, সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে। এটাই আওয়ামী লীগকে করেছে অনন্য, ব্যতিক্রমী।

ভাঙ্গন: বিভিন্ন সময় ভাঙ্গনও এসেছে আওয়ামী লীগে। তবে মহীরুহ এ দলটিকে টলাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। পরবর্তীতে ৬ দফা প্রশ্নেও দলে বিভক্তি আসে। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ ভেঙ্গে হয় জাসদ ছাত্রলীগ। তাদের মূল দল হয় জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)। পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসময়ে দলকে অনেক চড়াই-উৎরাই পোহাতে হয়। ৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দলকে সুসংগঠিত করেন। ৮২ সালে বাকশালের আলাদা কমিটি হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম সৃষ্টি হয়। ১/১১ সময়ে চ্যালেঞ্জের মুখেও টিকে থাকে আওয়ামী লীগ।

কর্মসূচি: আওয়ামী লীগের ৬৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে সকালে সূর্যোদয়ের সময় সকল কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে আটটায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং বিকেল আড়াই টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আলোচনা সভা। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ আলোচনা করবেন।

এদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল ৬৭ বছর পূর্তিতে সকল কর্মসূচি পালন এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সকল জেলা, উপজেলাসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।



মন্তব্য চালু নেই