সেই মহিফুল বিবির আত্মকথন :
“শেখের বেটি শেখ হাসিনাও আমার খোঁজ আর নিলো না”
দিনটি ছিলো ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল। তৎকালিন ও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন গ্রাম্য বিধবা মহিফুল বিবিকে দেখতে তার ভাঙ্গা ঘর আলো করে। তারপর কেটে গেছে ১৫ টি বসন্ত। কিন্তু মহিফুলের ভাগ্য বদলায়নি এতটুকুও বরঞ্চ কষ্টের মাত্রা আরো বেড়েছে নিদারুন ভাবে। অতি কষ্টে দিন এনে দিন খায় করে চলছে অভাবের সংসারটি। মহিফুলের এখন ৭৫ বছর বয়স, বয়সী বৃদ্ধা মহিফুল বিবি ৪ জন এতিম নাতি নাতনী আর বিধবা পুত্রবধুকে বুকে আগলে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন অবিরত জীবন যুদ্ধে। যেনো শত অভাব অনটন হার মানাতে পারেনি মহিফুলকে। মহিফুল কি রকম ভাবে বেঁচে আছে তার খবর এখন কেউ রাখেনা। মহিফুল দুঃখ করে বলেন “শেখের বেটি শেখ হাসিনাও আমার খোঁজ আর নিলো না।”
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যখন মহিফুলের বাড়ি এসেছিলেন তখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী আছেন। মহিফুল বিবিও তখন যেমনটি ছিলেন এখনো তেমনটিই আছেন, অভাবে অনটনে জর্জরিত এক বয়স্ক বৃদ্ধা। সেদিন মহিফুল ভেবেছিলো এবার হয়তো তার দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু না, সেটি হয়নি গরীবের বেদনা আরো বেড়েছি বৈ কমেনি। মহিফুল বিবিকে নিয়ে নির্মিত খ্যাতিমান চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের “মুক্তির কথা” প্রামান্য চিত্র দেশে বিদেশে ব্যাপক ক্ষ্যাতি অর্জন করলেও জীবন যুদ্ধে ছুটে চলা মহিফুলের ভাগ্য বদলায়নি আজও এতটুকুও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালবাসায় ধন্য আর খ্যাতিমান চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ প্রামান্য চিত্রের সেই মহিফুল বিবি এখন কেমন আছে, কি ভাবে বেঁচে আছে তার খবর এখন কেউ রাখেনা। কষ্টের সীমাহীন যন্ত্রনা বুকে চেঁপে স্বামী সন্তান হারা বৃদ্ধা মহিফুল এখনো ভাঙ্গা ঘরে খেয়ে নাখেয়ে দিন কাটায়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া স্বামীর সম্মানী ভাতা টুকু আজও ভাগ্যে জোটেনি এ হতভাগীর। ঘড়টিতে বাতাস দোলায় এপাশ থেকে অন্যপাশ।
আমরা ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া শহীদনগর ইউনিয়নের ছোট পাইককান্দি গ্রামে ছোট কুঁড়ে ঘরে মহিফুলের কথা বলছি। স্বামী জলিল মোল্যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। স্বামীকে হারিয়ে মাত্র দেড় বছরের শিশু সন্তানকে গভীর মমতায় বুকে আগলে রেখে বড় করেন। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে আর বিয়ে করেননি তিনি। তার পর অনেক দুঃখ বেদনায় সময় বয়ে গেছে কালের গর্ভে অনেক। একমাত্র সন্তান জাফর মোল্যাকে বড় করেছেন গভীর মমতায় সব ঝড় বুকে ঠেলে। আদর করে সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন। মহিফুল বিবি ৪ জন নাতি-নাতনীর দাদি হয়েছেন । সবার ধারনা এবার হয়তো মহিফুরের শেষ জীবনে সুখ শান্তি উপচে পড়বে। সবাই বলে দুঃখের পরে নাকি সুখ আসে। কিন্তু মহিফুল বিবির কপালে হয়তো বিধাতা সুখই লেখেননি।
২০০৯ সালে হঠাৎ একদিন একমাত্র সন্তান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে এবং মায়ের বুক শূণ্য করে শেষ বিদায় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। একমাত্র অবলম্বন সন্তান জাফরকে হারিয়ে, ছোট ছোট ৪ জন নাতি আর বিধবা পূত্রবধুকে নিয়ে আবার নতুন একটি যুদ্ধে সংগ্রামে অকুল সাগর পারি দিতে যন্ত্রনাময় পথে হাসি মুখে সবাইকে বুকে আগলে রাখছেন বয়সের শেষ প্রান্তে আসা মহিফুল বিবি। ভিটেবাড়ি আর জমি সব মিলিয়ে সম্বল মাত্র ৪০ শতাংশ জায়গা। ৬টি পেট এই সামান্য জমি, সংসারের আয় রোজগারের জন্য নেই কোন পুরুষ মানুষ। কিভাবে চলছে মহিফুলের সংসার কেউ জানেনা, কেউ খবর রাখেনা, কেউ খবর রাখেনি।
নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া শহীদনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার ও রাজাকারদের হাতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কথা এবং গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি নিয়ে প্রামান্য চিত্র নির্মাণ করেন খ্যাতিমান চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। তার চলচিত্রে উঠে আসে মহিফুল বিবি। সে দিন তারেক মাসুদের কাছে খুলে বলে তার সব কষ্ট সব নাবলা কথা। আক্ষেপ করে মহিফুল বিবি সেদিন বলেছিলো, “আপনের কাছে আমার দুঃখের কথা কইয়া কি লাভ ? যদি শেখের বেটি শেখ হাসিনারে আমার সামনে পাইতাম, তাইলে তারে আমার দুঃখের কথা খুইল্যা কইতাম। তারেক মাসুদের নির্মিত প্রামান্য চলচিত্র ‘ মুক্তির কথা’ দেশ-বিদেশে ব্যাপক ঝড় তোলে। মহিফুল বিবির সেদিনের কথা ‘মুক্তির কথা’ প্রামান্যচিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় দেশ-বিদেশে সর্বত্র। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ছবিটি দেখেন, প্রধানমন্ত্রী কে নিজ গ্রামের স্বামীর ভিটায় বসে মহিফুল বিবির এক নজর দেখার স্বপ্ন সেদিন জানতে পারেন শেখ হাসিনা।
মহিফুল বিবির স্বপ্নকে সত্যি করতে ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেন নগরকান্দার ছোট পাইককান্দি গ্রামের এক অসহায় বিধবা মহিফুলের ভাঙা ঘরে। সেদিন পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেনো আলো হয়ে মহিফুলের চোখে ঘর বেঁধেছিলো। মহিফুলকে সেদিন বুকে জরিয়ে ধরেছিলো গভীর মমতায়। গরীব অসহায় এ মহিলাকে নগদ ১০ হাজার টাকা, কিছু কাপড় ও চাল ডাল সাহায্য হিসেবে দিয়েছিলো সেদিনের ও আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বর্তমানে প্রধান মন্ত্রী আছেন, সেই মহিফুল বিবিও বেঁচে আছেন। কিন্তু মহিফুল বিবি এখন কেমন আছে, কি ভাবে বেঁচে আছে কেউ খবর রাখেনা। স্বামী হারা, সন্তান হারা মহিফুল বিবি আজও যুদ্ধ করছে ভাগ্যের সাথে। শরীর বয়সের ভাড়ে এখন আর আগের মত চলেনা। তবু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিধবা পুত্রবধু আর ৪ জন নাতিকে নিয়ে কষ্টের সীমাহীন যন্ত্রনা বুকে চেপে রেখে কাঁচা মাটির ভাঙা ঘরে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছেন হতভাগা নারী মহিফুল বিবি।
খ্যাতিমান চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ প্রামান্যচিত্রে উঠে আসা আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালবাসার সেই মহিফুল বিবি বলেন, “আমার এহন অনেক বয়স হইছে। শেখের বেটি সেদিন নেতাগো কইয়া গেছিলো আমার খবর নিতে। কিন্তু সবাই যার যার কাম কাজে ব্যস্ত। তারা কেও আমার খবর নেয় না। এই বয়সে আমার কিছু চাওয়ার নাই। শুধু একটাই দুঃখ, আমি মরার আগে আমার বিধবা পুত্রবধু আর নাতি গুলার জন্য একটা ভাল ঘর আর খাইয়া পইড়া বাঁইচা থাকার ব্যবস্থা করতে পারলাম না। শেখের বেটি শেখ হাসিনা যদি আমার নাতিগো একটু দেখতো, তাইলে আমি মইরাও শান্তি পাইতাম। ”
মহিফুল বিবি তার মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চায়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া তার স্বামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, অন্য সবার মত তার পরিবারের সদস্যরা যেনো ভাল ভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পায়, তার বিধবা পুত্রবধু ও নাতী নাতনীর জন্য এতটকুু আশ্রয়।
মহিফুলের এ সামান্য চাওয়া কি খুবই অযৌক্তিক মনে হয়? বৃদ্ধা মহিফুলের নিরব কান্না আর না পাওয়ার বেদনা বার বার এ প্রশ্নটি সবার দারে দারে আজ রাখছেন। আজও স্বপ্ন দেখে মহিফুল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই একদিন তার ডাক শুনবেন, গভীর মমতায় পাশে এসে দাড়াবেন। সেদিন হয়তো বদলে যাবে মহিফুলের জীবনচিত্র, দুঃখ বেদনা আর না পাওয়ার সব ব্যাথা যন্ত্রনা।
মন্তব্য চালু নেই