শুভ জন্মদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
শুভ জন্মদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যলয়। গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় এক দশক পূর্ণ করেছে। আজ এগারোতে পদার্পণ করেছে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আজ ১৫৭ বছরে পদার্পণ করেছে। বহমান সময়ের হাত ধরে এ প্রতিষ্ঠান পাঠশালা থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ অতঃপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমন অনন্য ইতিহাস নিয়েই পথ চলছে দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আজ তার শুভ জন্মদিন।
প্রতিষ্ঠানটির পেছনে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তা হলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষানুরাগী ব্রজসুন্দর মিত্র, অনাথবন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায় ও দীননাথ সেন যৌথ প্রচেষ্টায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি পাঠশালার যাত্রা শুরু করেন। পাঠশালাটির নাম দেন ব্রাহ্ম স্কুল । এই ব্রাহ্ম স্কুল কালের স্রোতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পেরিয়ে ২০০৫ সালে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। যার নাম দেওয়া হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল পরিচালনার ভার ১৮৭২ সালে গ্রহণ করেন বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী । তিনি এর নাম বদলে তার পিতার নামে রাখেন ‘জগন্নাথ স্কুল’।
১৮৮৪ সালে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর জগন্নাথ কলেজই রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই ঢাকাবাসীর উদ্দেশ্যে তার বিখ্যাত ভাষণটি দেন। ঢাকায় এসে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বক্তৃতা এই কলেজেই দিয়েছিলেন। এ সময় এটিই ছিল ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি কলেজ।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।
জগন্নাথ কলেজে আইএ, আইএসসি, বিএ (পাস) শ্রেণি ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কলেজটিকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয় । পুরোনো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারিকরণ করা হয়।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রার অল্প কয়েক বছরেই বিশেষত ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চ শিক্ষার্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত এর ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বহন করেছে। ২০১১ সালে এটি প্রকৃত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা অর্জন করে।
বর্তমানে ৫ শতাধিক শিক্ষক, সাড়ে ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে তিনি জানান, স্বপ্ন নয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাস্তবতা। এটাকে একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই তার প্রধান কাজ। অন্যান্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগন্নাথের পার্থক্য হলো, সরকারি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। জন্ম থেকেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এটি পথ চলা শুরু করেছে। তবে সব সমস্যা কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছয়টি অনুষদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৩৩টি বিভাগ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অন্তর্গত বিবিএ এবং এমবিএ প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী একদল শিক্ষক নিষ্ঠার সঙ্গে এই অনুষদে অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ ছাড়াও খুব কম সময়ের মধ্যে এই অনুষদের বিভাগগুলো উচ্চতর গবেষণা তথা এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছে।
সাবেক জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) কয়েকটি হল, হোস্টেল ও ডরমেটরি ছিল। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের আবাসিক হলের জন্য একাধিকবার আন্দোলন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান উপাচার্য হল নির্মাণের জন্য জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে কেরানীগঞ্জে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক হাজার আসনবিশিষ্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নবম প্রতিষ্ঠাবার্ষীকীতে এ হলটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। হলটির নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ চলছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ রফিকউদ্দিন (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী মোতাহের হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত ও নুরুল মোমেন, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আনিসুজ্জামান, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী সাঁতারু ব্রজেন দাস প্রমুখ এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদের একাধিক সদস্যও এ প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে; বাস্তবসম্মত কারণে রাতারাতি সবকিছুর সমাধান সম্ভব নয়। কেউই এ সমস্যা সমাধান করতে পারবেন না। তবে অবকাঠামো উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলছে।’ সামনে আরো বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রজেক্ট হাতে পাবেন বলে আশা করেন তিনি।
গৌরব আর ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রাখার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, উচ্চ মানসম্মত লেখাপড়া, পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়মিতকরণ এবং শিক্ষকদের জ্ঞান অন্বেষী মনোভাব আশানুরূপ হলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে।
দশমপ্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ : এ বিশ্ববিদ্যালয়টির দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজন হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মধ্যে রয়েছে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দিবসের শুভ উদ্বোধন, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভ উদ্বোধন করা হবে।
সকাল ১০টায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহীদ মিনার চত্বর থেকে শোভাযাত্রা বের হবে। শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে রায় সাহেব বাজার মোড় ঘুরে, ভিক্টোরিয়া পার্ক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শেষ হবে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন চত্বরে সকাল ১১টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ উপস্থিত থাকবেন।
এ ছাড়া দুপুর ২টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সন্ধ্যা ৬টায় যাত্রাপালা এবং রাত সাড়ে ৭টায় কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। এতে গান পরিবেশন করবেন হৃদয় খান এবং পাওয়ার ভয়েসের রাজীব।
মন্তব্য চালু নেই