শিশু তাজিনের ওপর দীর্ঘ আট মাস চলেছে নির্মম নির্যাতন!
ডান হাতের কনুইয়ের ওপরের অংশ ভাঙা। সেখানে লাগানো হয়েছে রড। একই হাতেই আবার বড়-ছোট মিলে একাধিক ক্ষতের চিহ্ন। অন্য হাতেও আঘাতের চিহ্ন। কেবল হাত নয়, দুই পা, কপাল, মাথাতেও একাধিক ক্ষত।
আট বছর বয়সী তাজিনের শরীরটা এখন ঠিক এ রকম। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে পাওয়া যায় তাজিনকে। আট মাস ধরে নির্যাতন করা হয়েছে ছোট শরীরটায়।
রাজধানীর আদর্শ এলাকা উত্তরা মডেল টাউনে কাজ করতে এসেছিল ছোট শিশু তাজিন। নির্যাতনের পর অবস্থা বেগতিক দেখে ঢাকা থেকে নিজ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয় তাজিনকে। তাজিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার পূর্ব জগতবেড় (টংটিংডাঙা) গ্রামের বাসিন্দা। তাজিনের বাবা ইউসুফ আলী একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।
অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটিয়ে তাজিন এখন তীব্র অপুষ্টিতেও ভুগছে। পিঠের এক পাশে একটি বড় ক্ষতসহ আরো বেশ কয়েকটি ক্ষত। তলপেটের ডান পাশে খানিকটা লম্বা দাগ যেটা খালি চোখে দেখে মনে হয় যেন অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। মুখের দুটি দাঁতও ভাঙ্গা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনজনকে আসামি করে পাটগ্রাম থানায় মামলা করেছেন তাজিনের মা আয়েশা বেগম। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া শিশুটি কারো সঙ্গে কথাও বলতে চাইছে না।
জানা যায়, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার পূর্ব সিন্দুর্না গ্রামের রুস্তম আলী খন্দকারের মেয়ে নিলুফা ইয়াসমীন এমির বিয়ে হয় এক সময়ের সৌদি প্রবাসী কুমিল্লার মোস্তাফিজুর রহমান শিমুলের সঙ্গে। উভয়ের বাসা রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে। নিজের সন্তানের সঙ্গে খেলাধুলার করানোর কথা বলে আট মাস আগে তাজিনকে গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এমির মা সালেহা বেগম।
মামলার এজাহারে জানা যায়, ঢাকায় আনার পরই ঠিকমতো কাজ করতে না পারার অজুহাতে তাজিনের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। শারীরিক নির্যাতন ও অপুষ্টিতে দুর্বল হয়ে পড়লে এমি তাজিনের মাকে ফোন করে মেয়েকে নিয়ে যেতে বলে। তবে তাজিনের মা এতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এমি এক ব্যক্তিকে দিয়ে গত রোববার তাজিনকে হাতীবান্ধা পাঠিয়ে দেন।
তাজিনের মা আয়েশা বেগম জানান, শরীরের এ অবস্থা দেখে এমির বাবার বাড়ির লোকজন ওই দিনই কৌশলে শিশুটিকে ভর্তি করে হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরে খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন গত সোমবার সন্ধ্যায় সেখান থেকে তাজিনকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করায় পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আবু মুসা বলেন, ‘শিশুটিকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কোনো ধাতব জিনিস গরম করেও শরীরে ছ্যাকা দেওয়া হয়েছে। ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ডান হাতে একটি রডও ঢোকানো আছে। এ ছাড়া সে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এই অবস্থায় তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।’
গত সোমবার রাতে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে তাজিন। তার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। সারা শলীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। অপুষ্টির কারণে শরীরের তুলনায় পেট কিছুটা বড় আর পেটের রগগুলোও যেন সব ভেসে উঠেছে। শিশুর এ অবস্থায় নিজের কান্না থামাতে পারছেন না মা আয়েশা। বিছানার এক পাশে বসে তিনি শুধুই কেঁদেই চলেছেন। আর সেখানে থাকা অন্যদের চোখও যেন করছে ছলছল।
তাজীনের মা আয়েশা বেগম জানান, তাঁর ছয়টি মেয়ে। কিন্তু স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় আয়েশা নিজেই দিনমজুরি করে সংসার চালান। কিন্তু এরপরও তাঁদের অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। তাই তাঁর এক মেয়ে অনেকদিন থেকেই কাজ করে এমির এক বড় বোনের ঢাকার বাসায়। সেই সুবাধে এমিও আয়েশার কাছে তার আরেক মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চায়। প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত ছোট্ট তাজিনকে ঢাকায় পাঠায় তার মা।
আয়েশা বেগম আরো জানান, তাজিনকে ঢাকায় নেওয়ার পর জানানো হয় তাজিন হারিয়ে যায় আর পরে তাকে (তাজিন) খুঁজে পাওয়া যায়। তাজিনকে খুঁজতে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকা আয়েশার কাছ থেকে দাবি করেছেন এমি। টাকা না দিলে মেয়েকে আর ফেরত না দেওয়ারও হুমকি দেন এমি। মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথাও বলতে পারতেন না বলে জানান আয়েশা।
হাসপাতালে তাজিন বলে, ‘ঘর ঝাড়ু দিতাম, এক ঝুড়ি করে কাপড়ও ধুয়ে দিতাম। এরপরও খালি আমাকে মারত। দিনে একবার খাবার দিত। কাজ করার আগে কখনো দেয়নি খাবার। মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতে একটি ছেলে আসত তখন আমাকে বাথরুমে আটকে রাখত এমি আন্টি।’
গত সোমবার রাতে তাজিনকে নিয়ে যাওয়া হয় পাটগ্রাম থানায়। তবে সেখানকার পুলিশ প্রথমে ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার সঙ্গে কথা বলে সেখানে মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা করলেও গতকাল মঙ্গলবার ভয়ে সেখানে (ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানা) যেতে পারেনি তাজিনের পরিবার। ফলে সন্ধ্যায় মামলাটি পাটগ্রাম থানাতেই করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে গৃহকত্রী নিলুফা ইয়াসমিন এমি, তাঁর স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান শিমুল এবং এমির মা সালেহা বেগমকে।
পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনী শংকর কর বলেন, ‘আমরা বিষয়টি মানবিক কারণে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছি এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এমি ও তাঁর স্বামীর মোবাইল ফোন দুটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
মন্তব্য চালু নেই