শিশুর ডিজিটাল মাদকাসক্তি-এড়িয়ে চলবেন যেভাবে
রায়ানের বয়স ১০। ছোট্ট ছেলেটা বাসায় বসে পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে যায়। সামনে পরীক্ষা। বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা খেলতে দেয়াও তো যায়না ছেলেকে। রায়ানের মা সুজান তাই অনেক ভেবে চিন্তে ছেলেকে কয়েকটা মোবাইল গেমস নামিয়ে দিলেন। অবসর সময়ে খেলার জন্যে। ছেলেও খুশি, মাও খুশি। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো কয়েকটা দিন পর। একটু একটু করে নিজের চোখের সামনেই ছেলেকে পাল্টে যেতে দেখলেন সুজান। মোবাইল গেমস ছেড়ে এক পা নড়তে চায়না রায়ান এখন।
এমনকি চুরি করে হলেও গেমস খেলা লাগবেই তার। খেলাগুলোও কিন্তু সাধারণ কোন খেলা নয়। খুন, রক্ত আর মৃত্যুর খেলা। খেলার জন্যে মিথ্যে কথা বলে সে এখন। আর পরীক্ষার ফলাফল? সেটা কী করে হবে? পড়ার বই রায়ান হাতে ধরতেই তো চায়না। এমনকি খাওয়া-দাওয়াতেও মন নেই তার। সবচাইতে কষ্টকর বিষয়টি হল, সুজান একদিন খেয়াল করলেন ছেলে রাতের বেলায় ঘুম বাদ দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। কী ভাবছেন? মিলে যাচ্ছে বিষয়টা আপনার সাথেও? কেন হচ্ছে এটা? এটা কি কোন অসুখ?
না! এটা কোন অসুখ নয়। তবে এটা এক রকমের নেশা। মাদকের চাইতেও বাজে নেশা। সম্প্রতি একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, আইফোন, স্মার্টফোন আর এক্সবক্সের মতন প্রযুক্তিগুলো এক রকমের ডিজিটাল মাদক। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের নানাবিধ আবেগীয় কর্মকান্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোকেন নামক মাদকটি এই ফ্রন্টাল কর্টেক্সকে বাজেভাবে প্রভাবিত করে। আর এই প্রযুক্তিগত পণ্যগুলো ঠিক কোকেনের মতনই আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সকে প্রভাবিত করে।
এটি এতটাই বাজেভাবে আমাদের আবেগকে প্রভাবিত করে যে, প্রযুক্তিগুলোর সান্নিধ্যে থাকবার সময় আমাদের শরীরে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ঠিক যতটা সময় শিশুরা প্রযুক্তির ধারে-কাছে ততটা সময়ই তাদের মন-মেজাজ ভালো থাকে। বাকিটা সময় অস্থিরতা, অনাগ্রহ আর বিরক্তিতে ভুগে থাকে তারা।
চিকিৎসকদের মতে, এটি এক ধরণের ইলেকট্রনিক কোকেইন। অন্যদিকে আমেরিকান নেভি এবং এডিকশন রিসার্চ ফর দ্যা পেন্টাগনের প্রধান ড. অ্যান্ড্রু ডোয়ানের মতে এই প্রযুক্তিগুলো এক রকমের ডিজিটাল ফারমাকিয়া বা মাদকের অপর নাম। কথাগুলো কিন্তু একেবারেই মিথ্যে নয়। গেমস খেলায় নেশাগ্রস্থ আপনার শিশুর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিন। দেখুন কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সে। অনেক সময় গেমসের জগৎটাই শিশুর কাছে সবকিছু হয়ে পড়ে। ফলে বাস্তবের ওপর থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে সে।
বাস্তবের সাথে গেমসের দুনিয়ার কোন মিল না পাওয়ায় অনেক বেশি হতাশ হয়ে পড়ে। উদ্বিগ্নতা আর উগ্র আচরণের প্রকাশ করে। ভাবছেন, কিন্তু তাহলে কী করবেন? খুব সহজ উপায়। চিকিৎসকদের মতে, প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ বেশি কাজের। তাই আপনার সন্তানকে এই গেমসের পৃথিবী থেকে দূরে রাখুন। দরকার পড়লে টেলিভিশনটাও বন্ধ করে দিন। নিশ্চয় মনে হচ্ছে, এটা কী করে সম্ভব? গেমস তো এখন সবাই খেলে। প্রযুক্তি তো সবার হাতে হাতে।
আপনি কি জানেন যে, আমরা এখন যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করি সেই গুগল, অ্যামাজন বা উইকিপিডিয়ার আবিষ্কারকরাও তাদের সন্তানদেরকে দূরে রাখেন প্রযুক্তির কাছ থেকে? এমনকি তারা নিজেরাও অনেকটাই দূরে থাকেন এগুলো থেকে। সিলিকন ভ্যালির বেশিরভাগ মানুষই তাদের সন্তানদেরকে প্রযুক্তিগত কোন প্রভাব নেই এমন বিদ্যালয়ে ভর্তি করান।
তাই আপনার শিশুকে যদি প্রযুক্তির এই ভয়াল নেশা থেকে দূরে সরাতে চান তাহলে এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করুন।
প্রথমত, অন্যসব নেশার প্রতিকারের সময় যেমন সেই নেশাজাতীয় দ্রব্যের কাছ থেকে আসক্তকে দূরে রাখা হয়, তেমনি ডিজিটাল এই নেশার ক্ষেত্রেও নেশার উদ্রেককারী বিষয়গুলোকে আসক্তের কাছ থেকে দূরে রাখুন।
দ্বিতীয়ত, অনেকসময় শিশুরা একলা থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদে ভোগে আর আশ্রয় নেয় প্রযুক্তির। তাই তাকে সময় দিন। খাবার টেবিলে চেষ্টা করুন কেউ যেন হাতে প্রযুক্তিগত কোন পণ্য নিয়ে না বসে। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলুন। মানসিকভাবে তাদেরকে আনন্দিত রাখুন।
তৃতীয়ত, শিশুর সাথে সরাসরি কথা বলুন। কেন তাকে গেমস খেলতে দেওয়া হচ্ছেনা, প্রযুক্তিগত পণ্যগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে দূরে রাখা হচ্ছে সেটা বলুন তাকে। ভালোভাবে তাকে বোঝান। তাহলে সে আপনাকে ভুল বুঝবেনা। বরং সাহায্য করবে।
চতুর্থত, শিশুকে বাস্তবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। তাকে গল্পের বই পড়তে দিন, সবুজ মাঠে দৌড়াতে দিন। তাকে সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত করুন। এতে করে তার কল্পনাশক্তি বাড়বে। তখন আর গেমস বা প্রযুক্তিগত পণ্যের অভাব বোধ করবেনা সে।
একজন শিশু তাই করে যেটা সে দেখে। তাই আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বসে থাকবেন আর তাকে একই কাজ করতে নিষেধ করবেন সেটা সে কেন মানতে চাইবে? তাই নিজেকেও এই নেশা থেকে বিরত রাখুন আর শিশুকে নিয়ে একসাথে চেষ্টা করুন প্রযুক্তির নেশাহীন সুস্থ জীবনযাপনের।
মন্তব্য চালু নেই