শিশুর উপর যৌনসন্ত্রাসের ভয়াবহতা ও এক ফটোগ্রাফারের আত্মকথা
‘মনের ভেতর কষ্ট বয়ে বেড়ানোর মত নিদারুণ যন্ত্রণা আর নেই।’ মার্কিন অভিনেত্রী ও লেখক মায়া অংলের কথা এটি। আর এই কথাটা যেন ছবির মাধ্যমে তুলে ধরলেন আফ্রিকাভিত্তিক ফটোগ্রাফার মারিলা ফুরার।
নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকেই এমন কাজের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন বলে জানান মারিলা। তিনি জানান, ‘আমার বয়স যখন পাঁচ, ‘তখন একজন আমার উপর যৌন সন্ত্রাস চালায়। এতকম বয়সে আমার বোঝার কথা না যে আমার উপর ঠিক কী হচ্ছিলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম খারাপ কিছু একটা হচ্ছে এবং এজন্য আমি নিজেকেই দোষারোপ করতে থাকি।’
মারিলা জানান, এ ঘটনার কিছুদিন পরে তিনি তার বাবা-মাকে বিষয়টি জানালে তারা খুবই কষ্ট পান। নিজেদের মেয়েকে ঠিকভাবে রক্ষা করতে না পারার জন্য অনুতপ্ত হতে থাকেন তারা। পরে ব্যবস্থা নেন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
মারিলা বলেন, ‘নিপীড়ন হয়তো খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি কিন্তু সেই ঘটনাটি তাকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। হয়তো সে বোঝেনি সে কী হারিয়েছে কিন্তু আসলে শিশুটি তার শৈশবই হারিয়ে ফেলে। শিশুটির নিষ্পাপ থাকার ব্যাপারটি হারিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমি পুরোপুরি বদলে যাই। আমি সুইমিং পুলে নামার সময়ও টি-শার্ট পরে নামতাম। পুরুষরা আমার দিকে তাকালে আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করতাম। এরপর পুনরায় কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে আমার অনেক সময় লেগে যায়।’
নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার আতঙ্কজনক অনুভূতি থেকেই ‘মাই পিস অফ স্কাই’ প্রজেক্টটি শুরু করেন তিনি। প্রকল্পটির আওতায় মূলত শিশুদের উপর হওয়া যৌন সন্ত্রাস নিয়েই কাজ করেছেন তিনি। এধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাই তিনি এই দেশটির ছবি তোলেন।
মারিলার ছবি তোলা শুরু হয় ২০০২ সালে। ছবিগুলোতে উঠে এসেছে নানা গল্প, অনেক শিশুর আর্তনাদ ও না বলা কষ্ট।
সেসময় দেশটির পুলিশের শিশু সুরক্ষা কমিটির সঙ্গে কাজ করেন মারিলা। তিনি আবিষ্কার করেন যে প্রতিবছর অসংখ্য শিশু এমন নির্মমতার শিকার হয় সেখানে। তখনই এই শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করার জন্য মনস্থির করেন তিনি।
নিপীড়নের শিকারদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে রয়েছে একটি হাসপাতাল। মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যে শিশুদের বিশ্বাস অর্জন করা খুবই কঠিন ছিলো বলে জানান মারিলা। কিন্তু পরিশ্রম আর কাজের প্রতি নিষ্ঠার কারণে তিনি সবার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি নিজেকেও একজন শিশু অধিকারের আন্দোলনকর্মী হিসেবেই মনে করেন। পরিবারের সম্মতি নিয়েই তিনি সাক্ষাৎকার নেন শিশুদের। প্রথমে তিনি শিশুদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেন আসলে তাদের সঙ্গে কী ঘটেছে। তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতাও শিশুদেরকে বলেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি আসলে কী করতে চান।
নিপীড়িত শিশুরা নিজেদের মন এবং দেহ থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মারিলা প্রথমে তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন।
কয়েক বছর শুধু ছবি তোলার পর মারিলা বুঝতে পারেন যে শুধু ছবিগুলো সম্পূর্ণ গল্পটি প্রকাশের জন্য যথেষ্ট না। তাই তিনি এসব শিশুদের নিয়ে আরো গবেষণা শুরু করেন। তিনি ওই শিশুদের বাবা-মা, পুলিশ কিংবা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সাক্ষাতকারে উঠে আসে অনেক তথ্য।
এমন একটি অভিজ্ঞতার পর শিশুটির মানসিক অবস্থা কেমন হয় সেটা নিয়েও গবেষণা করেছেন মারিলা। কিভাবে এই মানসিক ট্রমা থেকে তাদের উদ্ধার করা যায় সেটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
এমনকি যারা এই শিশুগুলোর উপর যৌন সন্ত্রাস চালিয়েছে তাদেরও সাক্ষাতকার নিয়েছেন এই ফটোগ্রাফার। তিনি এই নির্যাতনকারীদের কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেন এদের অনেককেই খুবই বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান, সৃজনশীল এবং শিশুদের প্রতি খুবই যত্নবান।
তাদের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রুপ সেশন চলে। তাদের মধ্যে একজন সবার সামনে মারিলাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি মনে করো আমরা রাক্ষস?’ ‘মারিলা বলেন, তারা যা করেছে তা সত্যিই ঘৃণ্য। কিন্তু কোনো কারণে আমি তাদের ঘৃণা করতে পারি না। কারণ বিভিন্ন ঘটনা আবিষ্কার করতে করতে ভালো-খারাপ, ঠিক-বেঠিক, সাদা-কালো কোন কিছুরই বিভেদ করার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছি।’
অনেক সাক্ষাতকারের পর আকস্মিকতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে শুয়ে থেকেছেন বলে জানান মারিলা। সেসময় এমন কিছু ঘটনা তিনি শুনেছেন যেটা কখনোই আশা করেননি।
এখনো তিনি এই যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলছেন। নিজের ক্যামেরায় তুলে আনছেন এমন কিছু ছবি যার পেছনে রয়েছে অনেক হিংস্রতা, নির্মমতা ও অসহায়ের নির্বাক আর্তনাদ।
ছবিটি ২০০৭ সালে যৌন সন্ত্রাসের শিকার এক শিশুর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান থেকে তোলা। ২৫ বছর বয়সী এক লোকের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় শিশুটি। মেয়েটির কবরের পাশে দাড়িয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেনি তার বন্ধু
মন্তব্য চালু নেই