শিশুর উপর ‘প্রিন্সেস ইফেক্ট’!
শিশুরা গল্প শুনতে শুনতে বড় হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ছোটবেলায় আমরাও তো কত গল্প শুনেছি দাদি-নানির কাছে। মা গল্প না বললে তো ঘুমই আসতো না। কিন্তু এই যে সারাক্ষণ এমন সব গল্প বলা যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই তা কি শিশুর জন্য আদৌ ভাল কোন ফল বয়ে আনে? বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা যারা ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, কোন একদিন রাজকুমার আসবে আর পংখীরাজে করে তাকে নিয়ে যাবে সুখের দেশে, এই স্বপ্ন কি তার বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে? আসুন জেনে নিই, মনোবিজ্ঞানীরা কী বলছেন –
প্রিন্সেস ইফেক্ট
আদরের সন্তানটি আপনার কাছে রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যখন ওদের এই রূপকথার গল্পগুলো শোনানো হয়, তখন কল্পনাতে ওরা নিজেদের সত্যিকারের রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা ভাবতে পছন্দ করে। বিশেষ করে এই প্রবণতা দেখা যায় মেয়ে শিশুদের মধ্যে, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘প্রিন্সেস ইফেক্ট’।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিংহাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সারাহ কোয়েন ১৯৮ জন শিশুর (যাদের গড় বয়স ৩ থেকে ৬.৫ বছর) ওপর একটি গবেষণা চালান পুরো ১ বছর ধরে, যেখানে উঠে আসে চমকপ্রদ কিছু তথ্য।
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব মেয়ে শিশুর নিজের দেহ নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে, তাদের বেশিরভাগই ডিজনির রাজকুমারীদের সিনেমা দেখে বড় হয়েছে। “সুন্দরী এবং নিখুঁত দেহের এই রাজকুমারীদের দেখে তারা এখন থেকেই ছিপছিপে গড়নের শরীর চাচ্ছে। নারীদের এই সমস্যা সারা জীবনই থাকে, আর এটা সত্যি সত্যি ডিজনি প্রিন্সেসের গল্প শোনার বয়সেই তৈরি হয়, অর্থাৎ যখন শিশুদের বয়স থাকে ৩-৪ বছর।” বলেন কোয়েন।
স্নো হোয়াইট, সিন্ডারেলা কিংবা বেল— জনপ্রিয় ডিজনি রাজকুমারী চরিত্রগুলোর দিকে একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখুন। তাদের চিকন কোমর, বড় বড় চোখ আর ফুটফুটে গাল ঠিকই চোখে পড়বে। বাস্তব জীবনে সবার পক্ষে এমনটা হওয়া সম্ভব না হলেও, ছোট থেকেই মেয়ে বাচ্চারা তাদের পছন্দের প্রিন্সেসের মতো হতে চায়।
শুধু তাই নয়, গবেষণাতে দেখা গেছে এই কারণে মেয়ে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই নিজেকে মানুষ নয় বরং মেয়ে হিসেবে ভাবতে শেখে। তাদের মনে সৌন্দর্য কামনা ও দুর্বলতার বীজ বোনা হয়ে যায় এই বয়সেই। একে সিন্ড্রেলা সিন্ড্রোমও বলা হয়। বড় হয়ে এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মেয়েরা রূপকথার গল্পের মতই নিজেদের শিকার বা ভিক্টিম মনে করে এবং একজন উদ্ধারকারীর আশায় থাকে। ছেলেদের বেলায়ও এর প্রভাব রয়েছে। তারা সবসময় নিজেদের শক্তিশালী এবং নারীর উদ্ধারকারী রূপে কল্পনা করে।
শিশুর পরিচয় হোক বাস্তবতার সাথে
হঠাৎ করেই ডিজনি প্রিন্সেসদের জীবন থেকে বাদ দেয়া কোনো সমাধান হবে না। বরং আপনার মেয়ে শিশুকে ছোট থেকেই শেখাতে পারেন বাস্তবতা সম্পর্কে। তাকে দেখান, একেক শিশু দেখতে আসলে একেক রকম এবং সবাই সুন্দর। গাঁয়ের রঙ, গঠন এগুলো কোন ব্যাপার নয়। তাকে এও বোঝান যে, খেলার পুতুল বা এনিমেশনের রাজকুমারি কোন বাস্তব চরিত্র নয়।
বাড়ুক সৃজনশীলতা
সারাক্ষণ গল্পের পরিবর্তে তাকে আগ্রহী করুন সৃজণশীল কাজে। ছবি আঁকতে দিন, কিছু তৈরি করতে দিন। বুদ্ধির খেলা শেখান। বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। তাকে এমন সব কাজে যুক্ত করে ফেলুন যাতে গল্পের প্রতি তার আগ্রহ কমে আসে। গল্প সে শুনতেই পারে, কিন্তু একই সাথে এটাও যেন জানে যে জীবনটা গল্পের চেয়েও সুন্দর।
আপনার শিশু কেমন মানূষ হয়ে বেড়ে উঠবে তা নির্ধারিত হয়ে যায় খুবই অল্প বয়সে। যে সময় আমরা ভাবি, সে কিছুই বোঝে না সেই সময়ই সে এমন কিছু মাইন্ডসেট তৈরি করে নেয় যা পরবর্তীতে আর বদলায় না। তাই সচেতন থাকুন একদম শুরু থেকেই। আপনার সচেতনতাই তাকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
মন্তব্য চালু নেই