শিশুদের হাতে অটোরিকশা, বাড়ছে দুর্ঘটনা
শিশু আলামিনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের দড়িচণ্ডীবের এলাকায়। বাবা মারা গেছেন বেশ কিছু দিন আগে। চার ভাইবোনের মধ্যে সে বড়। তাই বাবার অবর্তমানে মায়ের পাশাপাশি শৈশবেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে শিশু আলামিনকে।
শুধু আলামিন নয়, রিপন, নজরুল, মন্টুসহ আরো অনেক শিশুই সংসারের অভাব-অনটনের কারণে অটোরিকশার হাতল ধরেছে। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকলেও ভৈরবে শিশুকিশোর অটোরিকশাচালকদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। অনভিজ্ঞ এবং অপ্রাপ্ত বয়সে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই অটোরিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটছে। কিন্তু তারপরও মুনাফালোভী কিছু অটোরিকশা মালিক দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে এসব শিশুদের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
ভৈরবের ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ ১০টির বেশি আঞ্চলিক সড়ক এবং ভৈরব বাজার এলাকার অলিগলিতে প্রতিদিনশত শত অটোরিকশা চলাচল করে। যার বেশির ভাগই এসব শিশু-কিশোরদের চালাতে দেখা যায়।
এসব চালকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মূলত অভাবের কারণে এ ধরনের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাবা অসুস্থ থাকায় শৈশবেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে রিপন মিয়াকে (১২)। সে বলে, অনেক টাকা খরচ করে তার ভাই সৌদি আরব গেছে। সেখানে কাজ না পাওয়ায় সংসার এখন বেহাল। বাবাও অসুস্থ। সংসারে মা ও এক ছোট বোন রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ করছে রিপন।
শম্ভুপুর এলাকার নজরুল। বয়স ১৫ বছর। সেও সংসারের হাল ধরতেই কাঁচা বয়সে অটোরিকশার হাতল ধরেছে বলে জানায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছর আগে ভৈরব শহরের বঙ্গবন্ধু সরণির আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় অটোরিকশা দুর্ঘটনায় মাহি (৫) নামের এক শিশু মারা যায়। গত বছরের ১৭ এপ্রিল একই এলাকার জয় রহমান নামের এক স্কুলছাত্র অটোরিকশার চাপায় গুরুতর আহত হয়। গত বছরের ৮ মে চণ্ডীবের এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হন রাব্বি মিয়া, রুনা, শারমিন ও তাঁর তিন বছরের শিশুপুত্র বাদশা মিয়া। এরপর ২২ আগস্ট চণ্ডীবের রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন রাস্তায় এক নারী নিহত হন। এর কিছুদিন আগে ভৈরব বাজার বাগানবাড়ি এলাকায় মারা যান এক ব্যক্তি। গত বছরের নভেম্বরে রাস্তার পাশে মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভৈরব শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো. জাকির হোসেন কাজলকে চাপা দেয় একটি অটোরিকশা। এতে তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান।
এদিকে, গত ১৩ জানুয়ারি ভৈরবপুর দক্ষিণ এলাকার জালাল মিয়ার পাঁচ বছরের এক শিশু বাড়ির সামনের রাস্তায় অটোরিকশার চাপায় গুরুতর আহত হয়। বর্তমানে সে বাজিতপুরের ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে শিশু-কিশোর অটোরিকশা চালকদের হাতে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে অটোরিকশা চালানো থেকে এসব শিশু-কিশোরকে বিরত রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ ভৈরবের সাধারণ সম্পাদক মো. আলাল উদ্দিন বলেন, শিশুকিশোরদের হাতে অটোরিকশার চাবি তুলে দেওয়া মুনাফালোভী মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে শিশুকিশোরদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
জানতে চাইলে অটোরিকশা শ্রমজীবী মালিক-শ্রমিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান আবিদ বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত আছি। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন থেকেও আমাকে এ বিষয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে।’ খুব শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই সব মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে ভৈরব হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুল হক বলেন, শিশুকিশোর অটোরিকশাচালকদের প্রায়ই আটক করে জরিমানা করা হচ্ছে। পাশাপাশি চলছে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, যাতে এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশা পরিবর্তন করে তারা অন্য পেশা গ্রহণ করে।
ভৈরব পৌরসভার মেয়র, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাছ বলেন, সড়ক-মহাসড়কসহ পৌর এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকরা অটোরিকশা চালাচ্ছে। এতে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব বন্ধে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমেদ বলেন, শিশুশ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশুদের হাতে যারা অটোরিকশা তুলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে শিশু অটোরিকশা চালকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মন্তব্য চালু নেই