শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গলার ফাঁস পাস কোর্স
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রি পাস কোর্স এখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য দুঃসহ যাতনা ও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ভয়াবহ সেশনজট, কোর্সের মেয়াদ বৃদ্ধি, ঘনঘন পাঠক্রম বদল, নতুন বিষয় চালু, আকস্মিক সিলেবাসের কলেবর বৃদ্ধি, পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষার সময়সীমা বৃদ্ধি, নম্বর বণ্টন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ অভ্যন্তরীণ ও চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন- সবকিছু মিলে যেন একেবারে ত্রাহি অবস্থা। এসব বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সময় সময় জারি করা প্রজ্ঞাপন পড়ে এবং তা মানতে গিয়ে সবার নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যেমন, পড়াতে গিয়ে শিক্ষকরাও তেমনি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষের অন্ত নেই। রয়েছে হতাশা আর অন্তর্জ্বালাও।
সচেতন ব্যক্তি বা অভিভাবক ছাড়া বেশিরভাগ মানুষেরই বোধকরি জানা নেই ডিগ্রি পাস কোর্স এখন শিক্ষার্থীদের কাছে কী দুঃসহ বিড়ম্বনা ও সীমাহীন ভোগান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়াদ তিন বছরের কথা বলা হলেও নিদেনপক্ষে পাঁচ বছরের আগে যে কেউ স্নাতক (পাস) হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারে না, এটা বেশ পুরনো কথা। ২০১১ সালে যে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পাস করে অধীনস্থ কলেজগুলোয় তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিল, পাঁচ বছর পর তারা চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে এখন (ডিসেম্বর, ২০১৫) ফরম পূরণের কাজে ব্যস্ত। নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে ২০১৪ সালেই পরীক্ষা সম্পন্ন করে ডিগ্রি নিয়ে তাদের ঘরে ফেরার কথা। অথচ এখন পর্যন্ত কারও জানা নেই ২০১৪ সালের ডিগ্রি পাস ও সার্টিফিকেট কোর্স পরীক্ষাটি কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে। ২০১১ সালের এইচএসসি পাস নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি পাস করে বের হয়ে আসতে আসতে যে ২০১৬ সাল লেগে যাবে, এটা প্রায় নিশ্চিত।
যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক, জনকল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংস্কার বা পরিবর্তন করা সহজ কাজ নয়। যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়া এবং বাস্তবতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি না করে যখন কেউ কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, বস্তুত তারাই পড়ে বিপাকে; যা সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা, দুর্দশা ও ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৫ সালে আকস্মিকভাবে ডিগ্রি পাস কোর্স থেকে ১০০ নম্বরের আবশ্যিক বিষয় ইংরেজি তুলে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম) অধীন কলেজগুলো স্নাতক (পাস) কলা শাখায় ১০০ নম্বরের বাংলা (আবশ্যিক) ও তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ে ৯০০ মোট ১০০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। এভাবে বাণিজ্য শাখায় (ব্যবসায় শিক্ষা) ১০০০ নম্বর এবং বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীদের আবশ্যিক বাংলা ও আবশ্যিক ইংরেজি ছাড়া কেবল ঐচ্ছিক তিনটি বিষয়ে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয় (যা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত)। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সব কলেজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করার পর আরও ৩-৪ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া উল্লিখিত ব্যবস্থাই চালু রাখে। কিন্তু সহসাই এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সংস্কারের নেশায় পেয়ে বসে; নতুন কিছু করা চাই এবং তা শিগগিরই। ১৯৯৬, ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সাল; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একের পর এক পাস কোর্সে চালু করে প্রথমে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখায় ১০০ নম্বরের ইংরেজি (আবশ্যিক), বিজ্ঞান শাখায় বাংলা ও ইংরেজি- এভাবে সব শাখাতেই বাংলা ও ইংরেজিসহ মোট ১১০০ নম্বরের পাঠক্রম। আবশ্যিক বিষয় হিসেবে সবাইকে এখন বাংলা ও ইংরেজি পড়তে হয়।
এভাবে কয়েক বছর চলার পর দুই বছর মেয়াদি পাস কোর্সকে ২০০১-২০০২ সেশন থেকে তিন বছর মেয়াদে রূপান্তরিত করা হয়। সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয় পাস কোর্সেও। প্রতিটি ঐচ্ছিক বিষয়ে ৩০০ নম্বরের তিন পত্রকে করা হয় ৪০০ নম্বরের চার পত্রবিশিষ্ট। তখন থেকেই মূলত দুষ্টগ্রহের মতো সেশনজট নামের ভূতটি পাস কোর্স শিক্ষার্থীদের ঘাড়ের ওপর জেঁকে বসতে শুরু করে। চলতি শতাব্দীর শুরুতে কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই পাস কোর্সে ‘বাংলাদেশ স্টাডিস’ নামে ১০০ নম্বরের একটি কোর্স চালু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু চালুর ছয় মাসের মধ্যেও উপযুক্ত বই প্রণয়ন ও সিলেবাস তৈরি করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ওই কোর্সটি (বাংলাদেশ স্টাডিস) বাদ দেয়া হয়। এ নিয়ে অযথাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। এ সময় শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ‘১৪০০ নম্বরের’ চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমাদের দেশে (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) তো বটেই, বিশ্বের আর কোথাও এ ধরনের নজির আছে কিনা সন্দেহ। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আর কখনও একসঙ্গে এত বেশি নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়নি। কিন্তু সেশনজটের পরিধি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়তেই থাকে।
২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাস কোর্সে আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। ২০০২ সাল থেকে চালু ১০০ নম্বরের ৪ পত্রবিশিষ্ট ঐচ্ছিক বিষয়কে করা হয় ৬ পত্রবিশিষ্ট এবং আবশ্যিক হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে ১০০ নম্বরের একটি নতুন কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কোর্সটি অবশ্য অনার্স শিক্ষার্থীদের বেলায়ও আবশ্যিক হিসেবেই চালু রয়েছে। এছাড়া একই শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু করা হয়েছে ২০ নম্বরের ‘ইনকোর্স পরীক্ষা’ যা তত্ত্বাবধান করেন স্ব স্ব কলেজের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা। প্রতিটি বিষয়ভুক্ত পত্রের পরীক্ষার সময়সীমা প্রচলিত ৩ ঘণ্টার জায়গায় করা হয়েছে ৪ ঘণ্টা। পাস কোর্সে যুগ যুগ ধরে যেখানে ১০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ছিল ৩ ঘণ্টা; ২০ নম্বর কমানোয় এখন মাত্র ৮০ নম্বরের জন্য পরীক্ষার সময় রাখা হয়েছে ৪ ঘণ্টা। বাংলা ও ইংরেজি বিষয় নিয়ে টানাটানির ব্যাপারটিও শিক্ষার্থীদের অনেকবার ভোগান্তিতে ফেলেছে। এক সেশনে প্রথমবর্ষে তো পরের সেশনেই তৃতীয় বর্ষে। এভাবে বেশ ক’বার আকস্মিক রদবদল করায় শিক্ষার্থীদের বাংলা-ইংরেজির ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়তে হয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ডিগ্রি পাস কোর্সে এখন সব শাখায়ই (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের তিন বছরে মোট ২১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে (প্রথম বর্ষে ৭০০, দ্বিতীয় বর্ষে ৭০০ এবং তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষে ৭০০ নম্বর)। অর্থাৎ আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের তুলনায় দ্বিগুণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি নম্বরের পরীক্ষা সফলভাবে মোকাবেলা করে তবেই একজন শিক্ষার্থীকে পাস কোর্সে øাতক (গ্র্যাজুয়েট) হতে হবে।
যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা খ্যাতনামা কলেজে অনার্স কোর্সে ভর্তির সুযোগ পায় না কিংবা অন্যান্য কারণে ভর্তি হতে পারে না, তারাই সাধারণত অনন্যোপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজে পাস কোর্সে ভর্তি হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রি পাস কোর্সটি আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। সময়, অর্থ এবং অপরিমেয় মেধার অপচয় হচ্ছে দিন দিন। অপচয় হচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতিরও। কাউকে কি সহজে বিশ্বাস করানো যাবে যে, ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস’ করার পর ডিগ্রি পাস কোর্সে অনুষ্ঠিত ‘প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে’ ‘নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে’ কোনো রকম বিরতি ছাড়া পড়াশোনা করে একজন শিক্ষার্থী মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে ফরম পূরণের অপেক্ষায় রয়েছে! এরূপ হাজার হাজার ভাগ্যবিড়ম্বিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ধৈর্যের বিষয়টিকে আমি সম্মান জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এসব ভোগান্তি, বিড়ম্বনা ও হতাশা নিরসনের উপায় কী।
মন্তব্য চালু নেই