লালমনিরহাটের কিছু খবর :

লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর জেরো লাইন সামর্থ্যহীনদের জন্য মিলনমেলা

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর আর ওপারে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরের জেরো লাইন পাসপোর্ট ও ভিসা করতে সামর্থ্যহীন মানুষজনের মিলনমেলা হিসেবে খ্যাত হয়ছে। দুই বাংলার সামর্থ্যহীন মানুষগুলো যেন আপন-স্বজনদের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে এজন্য জেরো লাইনের এ মিলন মেলায় বাংলাদেশের বিজিবি ও ভারতের বিএসএফ কখনোই বাধা প্রদান করে না। দুই বাংলার মানুষ কথা বলে চোখে চোখ রেখে ভাবের বিনিময় হয় কথায় কথায় কিন্তু মাঝেখানে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ ফুটের দুরত্ব আর মাঝখানেই দেয়া হয়েছে হাল্কা কাটা তারের বেড়া। দুই বাংলার স্বজনা কথা বলতে বলতে অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠে কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারেনা। আর ওপারে বিএসএফ’র কঠোর নজরদারীর কারনে কেউ কাউকে কোন কিছু উপহারও দিতে পারে না।
”আমি পাসপোর্ট ও ভিসা করতে সার্মর্থ্যহীন কিন্তু ওপারের স্বজনদের সাথে প্রতিমাসে দুইবার করে মতবিনিময় করি জেরো লাইনের এই মিলনমেলায়,” জানালেন পাটগ্রাম উপজেলার কোর্টতলি গ্রামের আফজাল প্রামানিক। ”আমরা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলি আর বড়ই সাধ জেগে স্বজনের গলা ধরে একট কাঁদতে কিন্তু কাটা তারের বেড়া সে সুযোগ দেয় না,” জানালেন তিনি।
রংপুর থেকে সামর্থ্যহীন এক ব্যক্তি সুরেশ চন্দ্র বর্মন জানালেন তার অনেক আপনজন ভারতে রয়েছেন। তাদের সাথে দেখা করতে পাসপোর্ট আর ভিসা করবার সামর্থ্য তার নেই। তাই তিনি বছরে কমক্ষে চার বার বুড়িমারী জেরো লাইনের মিলনমেলায় ছুটে আসেন স্বজনদের সাথে কথা বলতে আর তাদের খোজখবর নিতে। ”গত চার বছর ধরে এখানে আসছি আর আমার স্বজনরাও আসেন জেরো লাইনে,” তিনি জানান।
আব্দুল হাই নামে এক কাস্টমস ইন্সপেক্টও জানালেন, গত ৫ বছর ধরে জেরো লাইনের মিলন মেলায় ভীড় জমছে সামর্থ্যহীনদের। শুধু সামর্থ্যহীনই নয় স্বচ্ছল পরিবারের লোকজনও এখানে এসে ভীড় জমান স্বজনদের সাথে কথা বলতে, ভাব বিনিময় করতে। ”বিসয়টি বেআইনী হলেও সাধারন মানুষের কথা ভেবে আমরা বিষয়টি মুক্ত করেছি। এতে দুই বাংলার মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বোধও বাড়ছে সেই সাথে সাধারন মানুষের আত্মবিশ্বাসও অটুট থাকছে,” এমনটি জানালেন ওই কাস্টমস কর্মকর্তা।
জেরোলাইনে কর্মরত এক বিজিবি সদস্য জানান, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর আড়াই পর্যন্ত জেরালাইনের এই মিলনমেলা সরব থাকে। আর প্রতি রোববার এটি বিকাল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। বিজিবি মাঝে মধ্যে তদারকি করে যাতে করে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি না হয।
বুড়িমারী স্থলবন্দরের কাস্টমস’র সহকারী কমিশনার মতিয়ার রহমান জানালেন দুই বাংলার স্থলবন্দরের জেরো লাইন মিলনমেলায় পরিনত হয় সামর্থ্যহীন মানুষের কলরবে। দুই বাংলার স্বজনরা একে অপরকে স্পর্শ করতে না পারলেও কথা বলা আর ভাবের আদান প্রদান করে তারা সন্তুষ্ট থাকে।

 

লালমনিরহাটে বন্য প্রানী ও পাখী শিকারীরা সক্রিয়
শীত মৌসুম আসলেই সীমান্তবর্তী লালমনিরহাটে সক্রিয় উঠে বন্য প্রানী ও পাখী শিকারীরা। শিকারীরা দেদারছে হত্যা করছে বন্য প্রানী ও পাখী। এ মৌসুমে সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন জাতের পাখীরা আসে অতিথি হয়ে আর এই সুযোগকে নিজেদের শিকারের কাজে লাগায় কিশু পেশাদার ও সৌখিন শিকারী। তবে বন্য প্রানী শিকার করতে দেশের আদিবাসী প্রবন এলাকা থেকে আদিবাসীরা দলেদলে আসেন এই অঞ্চলে। তারা গ্রামে গ্রামে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুড়ে শৃগাল, বনবিড়াল, বেজি, কাঠ বিড়ালীসহ বিভিন্ন জাতের বন্য প্রানী শিকার করে বাড়ীতে চলে যায়। শিকারীদের এরকম অমানবিক অত্যাচারে এ অঞ্চলে দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে অতিথি পাখী ও বন্যপ্রানী।
দিনাজপুর থেকে বন্যপ্রানী শিকারে এক সাঁওতাল আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য বংশাল সাঁওতাল জানালেন তারা প্রতিবছরই শীতকালীন সময়ে শিকারে বের হন। তবে আগের মতো আর শিকার করতে পারেন না কারন দেশে ঝোপঝাড় জঙ্গল হ্রাস পেয়েছে। ”আমরা বনজঙ্গলে ঘুড়ে বিভিন্ন বন্য প্রানী বিশেষ করে শৃগাল আর বনবিড়াল শিকার করে থাকি। শিকার করা বন্যপ্রানীর কিছুটা আমাদের পরিবারের জন্য রাখি আর কিছুটা কম্যূনিটির বিত্তশালীর কাছে বিক্রি করে টাকা রোজগার করি,” তিনি এমনটি বলে জানান তারা বন্যপ্রানী শিকারে কখনোই ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেন না। “দেশীয় অস্ত্র তীর ধুনক ব্যবহার করেই আমরা শিকার করে থাকি,” জানালেন অপর এক সাঁওতাল কম্যুনিটির বন্যপ্রানী শিকারী রাজং সাঁওতাল।
ঠাকুরগাঁও থেকে আসা বন্যপ্রানী শিকার সাঁওতাল কম্যুনিটির সদস্য মুরং নাথ জানালেন, বংশীয় রেওয়াজ রক্ষা করতেই তারা বছরে একবার শিকারে বের হন। বন্যপ্রানী শিকার তাদের পেশা নয় আর এটা কোনভাবেই উপার্জনের পথ নয় তাদের। ”আমরা দেশের আইনে শ্রদ্ধা করি আর তাই আগের তুলনায় ৮০ শতাং হ্রাস পেয়েছে বন্যপ্রানী শিকারে আমাদের শিকারী মনোভাব,” তিনি জানান।
লালমনিরহাট সদরের মন্ডলহাট গ্রামের স্কুল শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, বন্যপ্রানী শিকারীরা একটি দলে ১০ থেকে ১২জন থাকে। তাদের হাতে তীর ধনু আর লাঠি। তবে আগের তুলনায় এখন তাদের কমই দেখা যায়। ”কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু সৌখিন পাখী শিকারী বন্দুক নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি শিকার করেন স্বানন্দে। বন্যপ্রানী ও পাখী শিকার বন্ধ করতে দেশে আইন থাকলেও তার কোন প্রয়োগ নেই। আর শিকারীদের অব্যাহত শিকার হুমকীতে হ্রান পেয়েছে বন্যপ্রানী ও পাখী,” বল্লেন ওই শিক্ষক।
আদিতমারী উপজেলার দীঘলটারী গ্রামে বন্দুক হাতে পাখী শিকারে আসা নবীর হোসেন বলেন, তিনি সৌখিন বশত পাখি শিকার করেন। ছোটবেলা অভ্যস্থ হওয়ায় শীতকাল আসলেই তার এই নেশা জেগে উঠে বলে তিনি বলেন। ”আমরাতো সৌখিন শিকারীরা দু/একটা পাখি শিকার করি কিন্তু কিছু পেশাদার শিকারী আছে আর তরাই প্রতিদিন অনেক পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করছে সদম্ভে,” তিনি বল্লেন।
লালমনিরহাট সদরের বালাপুকুর গ্রামের পেশাদার পাখি শিকারী সালাম মিয়া বল্লেন আগের মতো আর পাখি পাওয়া যায় না। বাজারে বক ও সারস পাখির বেশ চাহিদা থাকায় তারা মাঠে মাঠে এসব পাখি শিকার করে থাকেন। এক একটি বক ও সারস পাখি তিন থেকে চারশ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে বলে তিনি জানান। তবে এ ব্যাপারে আইন আছে ও আইনে শাস্তির বিধান আছে এমনটি তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
লালমনিরহাট জেলা প্রানী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আবু হোসেনের সাথে কথা হলে জানান বন্য প্রানী ও পাখি শিকারীদের কিরুদ্ধে আইনে জেল ও জরিমান অথবা দুটোরই বিধান রয়েছে। জনবল সঙ্কটের কারনে তিনি মাঠ পর্যায়ে বন্যপ্রানী ও পাখি শিকারীদের সনাক্ত করতে পারছেন বলে জানান।

পুলিশ চার্জ দিলেও কান্না থামেনি লালমনিরহাটের এক হিন্দু পরিবারের
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বাউড়া ইউনিয়নের শফিরহাট এলাকায় এখনো কান্না থামেনি জামায়াত- বিএনপি সমর্তকদরে হামলার শিকার একটি হিন্দু পরিবারের লোকজনের। পুলিশ মামলার চার্জশিট দিলেও আতংক আর ভয় নিয়ে কাটছে ওই পরিবারটি লোকজনের। আইন ও শালিস কেন্দ্রের সার্বিক সহযোগিতায় পরিবারটি উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলেও হুমকী তাদের জন্য এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে।
ওই পরিবারটির দায়ের করা বাঁশ কাটা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাটগ্রাম থানার এসআই নজরুল ইসলাম ৬ জামায়াত-বিএনপি সমর্থকের নামে চার্জশিট তাখিল করেছেন রবিবার।
”আমরা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি এখন আদালত’র নির্দেশে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিবো,” এসআই নজরুল ইসলাম জানান।
পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় জামায়াত নেতা আবুল হোসেনের নেতৃত্বে একদল জামায়াত-বিএনপি সমর্থকরা গতবছর ১৩ জুলাই সকালে ওই হিন্দু পরিবারটির জমি বেদখল করতে যায়। এসময় পরিবারের লোকজন বাধা দিলে তারা হিন্দু পরিবারটির চার সদস্যকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে এবং তাদের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহতদের প্রথমে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই জামাায়াত নেতার প্রভাব রংপুর পর্যন্ত থাকায় আহত হিন্দু পরিবারের লোকজনকে চিকিৎসার আগেই রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে বের করে দেয়। খবর পেয়ে ১৮ জুলাই আইন ও শালিস কেন্দ্র থেকে একটি টিম ঘটনাস্থলে এসে ওই হিন্দু পরিবারটির গুরুতর আহত বৃদ্ধা পুষ্প রানী সেন, তার ছলে শ্যামল চন্দ্র সেনকে ঢাকায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেন। বেশ কয়েকটি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে বাড়ীতে ফেরেন তারা।
হিন্দু পরিবারটি জমি বেদখল, বাড়ীতে অগ্নি সংযোগ ও রক্তাক্ত আহত করার ঘটনায় মামলাটির চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ আর সেটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও রয়েছে এবং পুলিশ তাদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশের এসআই নজরুল ইসলাম জানান, প্রথম দফার হামলার পরও ওই চক্রটি থামেনি। চক্রটি পুনরায় গতবছর ২৮ সেপ্টেম্বও দিন জোড়পুর্বক ওই হিন্দু পরিবারটির বাঁশঝাড়ে এসে বিপুল পরিমানে বাঁশ কেটে নিয়ে যায়। হিন্দু পরিবারটি থানায় ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ সুষ্ঠ্য তদন্ত স্বাপেক্ষে চার্জশিট তৈরী করে। এর মধ্যে ওই জামায়াত নেতা আবুল হোসেন আদালতের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু পরিবারটির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করলে পুলিশ তদন্তে এর কোন সত্যতা পায়নি তাই মামলাটিকে মিথ্যা ঘোষনা দিঢে পুলিশ চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
ওই হিন্দু পরিবারটি গৃহবধু দিপালী রানী সেন জানান, তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। হামলাকারীরা প্রভাবশালী এবংেে যকোন সময় বড় ধরনের কুচক্রান্তে তাদের ফাসাতে পারে এমনকি হামলাও করতে পারে।
কমল চন্দ্র সেন জানান, আইন ও শালিস কেন্দ্র সহযোগিতা না করলে তারা তাদের বৃদ্ধা মা বাঁচাতে পারতো না। আইন ও শালিস কেন্দ্রের দেয়া আইনি সহযোগিতায় তারা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করছেন। ”জানি না জামায়াত- বিএনপি’র এ খপ্পর থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো। ভয় আর আতংক নিয়ে জীবন চলা অমানবিক হয়ে উঠেছে,” এমনটি জানালেন কমল চন্দ্র সেন।
শেষ সম্বল বসতভিটা, একটি বাঁশ ঝাড় আর একটুকরো আবাদি জমি নিয়ে এই হিন্দু পরিবারটি বেঁচে আছে। সেটির উপর জামায়াত নেতার অবৈধ লোভ পরিবারটিকে ক্লান্ত শ্রান্ত করে তুলেছে। আইনি লড়াই কবে শেষ হবে আর তারা পুর্ন অধিকার নিয়ে নিজেদের সম্পদ ভোগ করবেন এটাই এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই