লাউয়াছড়া উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে রশি টানাটানি!

মৌলভীবাজার : প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল সমূহের মধ্যে যেসব অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী বেঁচে আছে তাদের অন্যতম নিরাপদ আবাসস্থল হল ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান’।

রেলওয়ে বিভাগ ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে আর অন্যদিকে বনবিভাগ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কথা চিন্তা করে গাছ না কাটার কথা বলছে। এ নিয়ে রেল ও বন বিভাগের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি।

লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে রয়েছে সিলেট-আখাউড়া রেলপথ। শুধু লাউয়াছড়া পাহাড়ের মধ্য দিয়েই রেলকে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। চলতি বছর এ উদ্যানে ঝড়-তুফানে শত বছরের পুরোনো বেশ ক’টি গাছ উপড়ে ও ভেঙে ব্যাহত হয়েছিল ট্রেন চলাচল। ট্রেন যাত্রীদের নির্বিঘ্নে চলাচলও দুর্ঘটনা এড়ানোর কথা চিন্তা করে রেললাইনের পাশের ৫০ ফুট পর্যন্ত এলাকার ২৫ হাজার গাছ কর্তন করা প্রয়োজন জানিয়ে বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছে রেলওয়ে বিভাগ। এরপর থেকে শুরু হয়েছে জেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কর্মীরা দাবি করছে রেলপথ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গাছ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মো. আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানান যে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের কি. মি. ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ পর্যন্ত ৫ (পাঁচ) কিলোমিটারের মধ্যে নির্বিঘ্নে ট্রেন চলাচলের জন্য ও দুর্ঘটনা এড়াতে উভয়পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত এলাকার গাছ-পালা কাটতে হবে।

চিঠির জবাবে বন্যপ্রাণী বিভাগ জানান যে, আমাদের জরিপে দেখা যায় পাঁচ বৎসর বয়স থেকে শুরু করে শত বৎসর বা তার অধিক বয়সের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কর্তন করা প্রয়োজন। এছাড়া, উক্ত এলাকার প্রতি এক বর্গমিটার এলাকাতে প্রায় ২০টি সিডলিং (চারা) এবং লতাপাতা, ঝোপ-ঝাড় বিদ্যমান, যেটা ছোট-ছোট বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এত গাছ কাটা করা হলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করাসহ জীব বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ মৌলভীবাজার জেলার সহকারী বন সংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অঞ্চলের মধ্যে যে সকল অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী বেঁচে আছে তাদের অন্যতম স্থান হচ্ছে ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান’। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে আমরা জরিপ করে আমাদের জবাব জানিয়ে দিয়েছি। এই চিঠির মানে এই বুঝাচ্ছে এলাকায় অবস্থিত সব গাছ কাটা মানে প্রায় ২৫ হাজার জীবন্ত ফলজ, বনজ ও ওষুধি এবং লক্ষাধিক ছোট্ট ছোট্ট চারাগাছের অকাল মৃত্যু। এটা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস ছাড়া কিছুই না।

তিনি আরো বলেন, ‘উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেল লাইনের উভয়পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট এলাকার ভেতরের গাছ-পালা কর্তন করা প্রয়োজন নেই।’

অপরদিকে একই চিঠিতে জানানো হয়েছে যে, রশিদপুর-সাতগাঁও সেকশনের কি.মি. ২৭১/২-২৭৯/৭ পর্যন্ত উভয় দিকের ৫০ ফুট গাছ কর্তন করার জন্য।

এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী বিভাগ জানায়, এ এলাকার রেললাইনের পাশে সামাজিক বনায়নের আওতায় সৃজিত বাগানটি সিলেট বনবিভাগের আওতাভুক্ত। উক্ত গাছ সিলেট বন বিভাগ নিলামে বিক্রয়ের মাধ্যমে কাটার কাজ চলমান রয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেললাইনের ওপর ভেঙে পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০টির মতো গাছ রেললাইনের উপর পড়ে। এতে উপবন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এ অবস্থায় উদ্যান এলাকার রেললাইনের উভয় পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে। একইভাবে রেললাইনের রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উভয় পাশের গাছও কাটতে হবে। নাহলে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’-এর ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেয়া হবে।

রেলওয়ে বিভাগ থেকে বন্যপ্রাণী বিভাগকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, একাধিকপত্রের মাধ্যমে পত্রের মাধ্যমে রশিদপুর-সাতগাঁও এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ রেল সেকশনের পাহাড়ি অংশের রেলপথের উভয় পাশে গাছপালা কাটার অনুরোধ জানানো হলেও অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অথচ উক্ত সেকশন সমূহে প্রায়ই ঝড়ো বাতাসে গাছপালা ভেঙে রেলপথের উপর পড়ে রেলপথ অবরুদ্ধ করে ফেলছে। ফলে ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে এবং ট্রেনে ভ্রমণকারী যাত্রী সাধারণের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ট্রেনে ভ্রমণকারী সম্মানিত যাত্রী সাধারণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানকল্পে রেলগাড়ি চলাচলে বিপদ বা বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বৃক্ষ অপসারণে রেল কর্তৃপক্ষ ‘দি রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’ এর ধারা ১৫ মোতাবেক পূর্ণ ক্ষমতাবান। কাজেই আপনি যদি আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে রেলপথের উভয় পার্শ্বে ঝুঁকিপূর্ণ গাছ সমূহ অপসারণে কার্যকরী উদ্যোগ না গ্রহণ করেন তাহলে রেল আইনবলে জনস্বার্থে গাছগুলি অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মিহির কুমার দে বলেন, আমি মনে করি এই চিঠি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি বাস্তবায়ন হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যোগ হুমকির মুখে পড়বে।

ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মো. আরমান হোসেন বলেন, ‘রেল লাইনের উভয়পাশে ঝুঁকি পূর্ণভাবে কিছু গাছ হেলে পড়েছে। সেগুলো প্রাথমিকভাবে আমরা কাটার চেষ্টা করেছি। গাছ কাটার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আমরা বন বিভাগকে চিঠিও দিয়েছি। আর গাছ কাটার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লোকবলও নেই। লোকের জন্যও কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। লোকবলের অনুমোদন পেলেই আমরা গাছগুলো কেটে ফেলব।’

এদিকে, লাউয়াছাড়ার গাছ না কেটে রেলপথকে অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার দাবিতে গত রোববার সিলেটে বিশেষ মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা।



মন্তব্য চালু নেই