“রোহিঙ্গা”- রাষ্ট্রবিহীন এক জনগোষ্ঠী
সাফাত জামিল শুভ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি- রোহিঙ্গা।এটি মূলত পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলিম। মায়ানমারের সরকারী হিসেব মতে, প্রায় আট লক্ষ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে।
পত্র-পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বইয়ের তথ্য সূত্রে বা স্বল্প কথায় তাদের ইতিহাস বর্ণনা অত্যন্ত কঠিন। রোহিঙ্গা শব্দটি রৌহিঙ্গা বা রোহিঙ্গিয়া শব্দ থেকে এসেছে, যা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা। আর এই ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার রয়েছে অবিশ্বাস্য মিল এবং বাংলার সঙ্গেও কিছুটা। অন্যমতে রোহিঙ্গা শব্দটি ‘রাহমা’ শব্দ থেকে এসেছে। অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের জাহাজ রামরি দ্বীপে এসে পৌঁছলে তৎকালীন আরাকানের রাজা তাদের আশ্রয় দেয়। তবে এই দয়ার কারণে বণিকরা আরাকানের অধিবাসীদের ‘রাহমা’ বলে ডাকতেন (রাহমা অর্থ দয়াবান)। মতান্তরে ‘ম্রৌহাঙ্গ’ শব্দ থেকে রোহিঙ্গা শব্দটির আগমন।
পূর্বে আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারকবাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। এমনকি আরাকানের সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমান রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃতাত্ত্বিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আরাকান অঞ্চল থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলার সব আয়োজন শেষ করেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তা ছাড়া আরাকানের মগ সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের আরাকানি জাতিগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে পরিচয় দিতেও নারাজ। ফলে ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গারা। উল্লেখ্য, মায়ানমার সরকার ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, রোহিঙ্গারা এই তালিকার অর্ন্তভুক্ত নয়। মায়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হল বাংলাদেশী, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস বলে, মায়ানমারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গারা।
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা হতে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মায়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয় পত্র থাকাটা খু্ব জরুরি বিষয়। কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র ইস্যু করে না, ফলে, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।
মায়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশীরা কোন সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মায়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা, “বিদেশী”। তাই, রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসকল ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মায়ানমার সরকার যেকোন মুহুর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।তারা আইনের মাধ্যমে রীতিমত অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন।
রোহিঙ্গারা সরকারী চাকুরী করতে পারে না, সরকারী কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।
অন্যদিকে প্রায়ই মায়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়ণের খবর পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারী জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসায় দখল/বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ‘গ্যাটো’ জাতীয় বিশেষ ধরণের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে ওরা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা এই গ্যাটোগুলোতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ও নিম্নমানের। রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। এইসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের ‘গ্যাটো ব্যবস্থা’ তালিকাভুক্ত নয়, ফলে, এদের জীবন ফোঁড়ার উপরে বিষ ঘা এর মত। এরা গ্যাটোগুলোতে থাকতে পারে না। আবার, গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মায়ানমারের নাগরিক নয় ওরা।অবস্থাটা ওদের এমন যে, মায়ানমার সরকার ওদের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এইসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যায় অসংখ্য রোহিঙ্গা।
বিগত কয়েক দশক ধরে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো কম।
রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মায়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেফতার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মায়ানমার সরকার। সরকারের নিপীড়ণের সাথে নতুন যোগ হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনসহ অন্যান্য বৌদ্ধ আরাকানীদের উস্কানি দিচ্ছে মায়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে বৌদ্ধ মৌলবাদকে সরাসরি ইন্ধন ও মদদ যোগাচ্ছে মায়ানমার সরকার।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্ব সমাজ চুপ করে বসে নেই, বিক্ষোভ মিছিল ও নিন্দা জানাচ্ছে। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামাসহ অনেকে গণতান্ত্রিক নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার পর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন নতুন বেসামরিক সরকার, উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচিব উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রদানের কথা বলেছেন। তবে এটা সত্য যে, সূচি এ সমস্যা ভুলে থাকতে চান না। ক্ষমতাসীন এনএলসি দল তাদের ‘রাখাইন মুসলিম’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার বাধ্য হয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি রাখাইন উপদেষ্টা কমিশন গঠন এবং জাতিগত দাঙ্গার স্থান ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছে। দীর্ঘদিনের জটিল এবং স্পর্শকাতর এই ইস্যুর স্থায়ী সমাধান হোক তারা নাগরিক ও মানবাধিকার পুনরায় ফিরে পাক।
মন্তব্য চালু নেই