রোজায় করণীয় ও বর্জনীয়

মহান আল্লাহ তায়ালা মোসলমানদেরকে হিজবুল্লাহ তথা আল্লাহর বাহিনী বলে ঘোষণা করেছেন। দুনিয়ার শাসকরা যেমন তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়, মহান আল্লাহ তায়ালাও তেমনি করে মোসলমানদের চারিত্রিক, নৈতিক ও মানবিক গুণের বিকাশের জন্য মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যেন মোসলমানরা সব লোভ, মোহ, অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের সব রকমের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারে।

এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি মানবতার উপকারের জন্যই তোমাদেরকে বাছাই করা হয়েছে।’ (আল-কুরআন)

সুবহে সাদিক থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খানা-পানীয় ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম বা রোজা। সিয়াম বা রোজা শব্দের অর্থ- বিরত থাকা। রোজা সব ধরনের অন্যায় পাপাচার ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। আর তাই প্রত্যেক মোসলমানদের জন্য ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা রাখার বিধানকে ফরজ করা হয়েছে। এ বিধান আল্লাহ প্রদত্ত একটি মৌলিক ইবাদত ও প্রশিক্ষণ। তাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীকে মাহে রমজানে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে।

রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারেরা তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেন তোমরা তাকওয়া তথা খোদাভীতি পূর্ণ সংযমী জীবনে অভ্যস্ত হতে পার।’ (আল-কুরআন)

হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে মিথ্যা ও পাপাচার ত্যাগ করতে পারলো না সে খানাপিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (আল হাদীস)

আল্লাহর নবী (সা.) আরো বলেন, ‘যে ঈমানদারী ও আত্মসমালোচনার সাথে রোজা রাখবে আল্লাহ তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (আল হাদীস)

রোজাদারের জন্য বিশেষ বেহেশতের নাম হলো রাইয়ান। (রাইয়ান শব্দের আভিধানিক অর্থ পিপাসামুক্ত)। রোজাদাররা ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভোগ করে রোজা রাখার প্রতিদান স্বরূপ সুখের বাসস্থানকে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।

রমজান মাসে রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং অধিক দুষ্টু ও নেতৃস্থানীয় শয়তানগুলোকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়।(বোখারি)

রিয়াদুস সালেহীন কিতাবে হজরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, ‘রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে রোজা রাখলো, আল্লাহ পাক সেই এক দিনের কারণে তার চেহারাকে ৭০ বছর দূরত্বের ন্যায় দোজখ থেকে দূর করে দেবেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)

আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষের হেদায়েতের জন্য পথ নির্দেশনার বিস্তারিত বর্ণনাসহ সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসাবে এই রমজান মাসেই কুরআন নাজিল করেছি।’

আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসে যে একটি ভালো কাজ করবে সে যেন একটি ফরজ আদায়ের কাজ করলো, আর যে একটি ফরজ আদায় করলো সে যেন ৭০টি ফরজ আদায় করলো। এ মাস ধৈর্য্য ও সহানুভূতিশীল হওয়ার মাস।’

রোজায় মোসলমানদের করণীয়:
১. রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা, পবিত্রতা রক্ষার জন্য অন্যকে উৎসাহিত করা।
২. ঈমানদারী ও আত্মসমালোচনার সাথে হিসাব করে রোজা রাখা।
৩, সব ধরনের মিথ্যা, পাপ, দুর্নীতি ও অপকর্ম চিরতরে বর্জন করা।
৪. রোজা রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী নিজের জীবন পরিবার ও সমাজ গঠনের চেষ্টা করা।
৫. কুরআন পড়া, বুঝা এবং কুরআনের শিক্ষা ও দাবি অনুযায়ী পরিবার এবং সমাজ গঠন করা।
৬. ধৈর্য্য ও ত্যাগের গুণ অর্জন করা।
৭. গরীব অসহায় মানুষের প্রতি সদয় হয়ে তাদের সাহায্য করা।
৮. আল্লাহর নবী (সা.) রমজান মাসকে রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির মাস ঘোষণা করেছেন তাই সবার উচিৎ রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তি লাভ করার জন্য আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করা।
৯. অতীতের সব রকমের ভুল-ত্রুটির জন্য তাওবা করা, ভবিষ্যতে ওই ধরনের অন্যায়, ইসলাম, সমাজ, দেশ ও মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত না হওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তাওবা ও সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকা।

রোজা রাখার নিয়মাবলী
১. রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খানাপানিয় ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। সব অন্যায় মিথ্যা ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. রোজার নিয়ত করে রোজা রাখতে হবে। (রোজার নিয়ত: নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিনশাহরি রামাদানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিয়ুল আলিম।)

রোজা রাখলে মনে রাখতে হবে:
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা দোজখের আজাব থেকে বাঁচানোর ঢাল স্বরূপ। ঢাল দুর্বল হলে শত্রুর আক্রমণ থেকে জীবন রক্ষা করা কঠিন। অতএব প্রত্যেক মোমেনের কর্তব্য যেসব কারণে রোজা দুর্বল হয় তা থেকে বিরত থাকা।’ (বোখারি)।

১. রোজা রেখে ভুলে কিছু খেলে রোজা ভঙ্গ হয় না। যদি মনে হওয়ার সাথে সাথে খানা বন্ধ করে।
২. নির্ধারিত সময় অর্থাৎ সুবহে সাদিক হওয়ার পরও খেতে থাকলে রোজা হবে না।
৩. রোজা রেখে তেল সাবান ও আতর ব্যবহার করা যায়। তবে আগরবাহি, টুথপেস্ট ও দাঁতের মাজন ব্যবহার করা যাবে না।
৪. নির্ধারিত সময়ের আগে ইফতার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
৫. অজু বা গোছলের সময় মুখভর্তি পানি গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে।
৬. যে কোনোভাবে বীর্যপাত ঘটালে রোজা ভেঙে যাবে। (তবে ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত হলে রোজা হালকা হয়ে যায়। তাই রোজা রেখে না ঘুমানোই উত্তম।)
৭. ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙলে ১টি রোজার পরিবর্তে ৬০টি রোজা কাফফারা দিতে হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙলে ১টি রোজার পরিবর্তে ১টি রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে।

রমজানের শিক্ষা:
রোজার মাধ্যমে ইসলামী জীবনের প্রায় সব ইবাদত ও অনুষ্ঠানের শিক্ষা দিয়ে থাকে।

১. রমজানের ১ মাস যেভাবে আল্লাহকে ভয় করে তার এবাদত-বন্দেগী করে জীবন অতিবাহিত করা হয়, রমজানের পর সেভাবে বাকি ১১ মাস আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহর দেয়া আদেশ-নিষেধ মত জীবন যাপন করা।
২. মহব্বতের সঙ্গে কুরআন পড়া, কুরআনের দাবি ও শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করা।
৩. নিজের জীবন ও চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সক্রিয় ও সচেতন থাকা।
৪. আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা এবং আর্দিষ্ট কাজগুলো আমল করা এবং ত্যাগ ও ধৈর্য্যরে গুণ অর্জন করা।
৫. লোভ-মোহ পরিহার করা এবং গরীব অসহায় মানুষের জন্য সহায়ক হওয়া এবং সাহায্য সহযোগিতা করা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে ধৈর্য্যের এবং রোজা রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন ও চরিত্র গঠনের তাওফীক দান করুন।



মন্তব্য চালু নেই