রূপবৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাফাত জামিল শুভ, চবি প্রতিনিধি : ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও বাংলাদেশের সিলেটের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত “ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভারসিটি হটস্পট।” এ হটস্পট’কে জীব জগতের বিভিন্ন প্রজাতির একটি ‘আকর স্থান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট (ডব্লিউআরআই)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ জোনের মধ্যে “সুপার হটস্পট” হিসেবে চিহ্নিত। কারণ এই ক্যাম্পাসের ১৭৫৪ একরের বিস্তৃত জায়গায় বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ সহ অগণিত প্রাণী-প্রজাতির বসবাস, সংখ্যায় যা একপ্রকার অবিশ্বাস্য।
মূল ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথেই দেখা যায় দু’পাশেই ছবির মত সুন্দর সুউচ্চ পাহাড়। এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে নয়নজুড়ানো পথ যা ‘কাটাপাহাড়’ রাস্তা নামে পরিচিত।এখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ, যা দেশের মধ্যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়েই পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা এ কাটা পাহাড়কে সুপার হটস্পটের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এখানকার জীববৈচিত্র্য যেমন দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে ব্যতিক্রম, তেমনি প্রাচুর্যের দিক থেকেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
চবির বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে-সাদামাটা নাকুটি, তিন প্রজাতির সুঁইচোরা, একাধিক প্রজাতির ঘুঘু, কয়েক প্রজাতির মাছরাঙা, ময়না, টিয়া, মুনিয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অন্যান্য পরিচিত পাখিগুলোও পর্যাপ্ত সংখ্যায় দেখা যায়।
তবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বনরুই, লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, পিগটেল বানর (শুয়োর লেজী বানর)সহ বেশ কিছু প্রাণী এখন আর দেখা যায় না। বুনো শূকর, চিতাবাঘ এখন আর দেখা যায়না। কমে যাচ্ছে মায়া হরিণেরও সংখ্যা। রেসাস বানরও অনেক কমেছে আগের তুলনায়।
এখানে রয়েছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখি। স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ১৬ প্রজাতির। দেশে আবিষ্কৃত ৩৫ প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে ২৫ প্রজাতিরই দেখা মেলে চবিতে। তবে সরিসৃপের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৩ সালে এখানে সাক্লোমিস ডেনটাটা নামের বিরল প্রজাতির একটি কাছিমও পাওয়া গিয়েছে।
ব্যাঙ এর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাপ্তিস্থান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে বাংলাদেশে প্রথম আবিষ্কৃত ফ্যাজারভেরিয়া আসমতি (বাংলাদেশি ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ), সুন্দরী ব্যাঙ, চীনা ব্যাঙ, তাইপে ব্যাঙ (২০০৬ সালে তাইওয়ানে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। পরে চবিতে এর সন্ধান পাওয়া যায়), ২ প্রজাতির গেছো ব্যাঙ প্রভৃতি। এছাড়া আরো এক প্রজাতির গেছো ব্যাঙ পাওয়া গেছে যেটা এখনও জরিপের আওতায় আসেনি।২০০০ সালে আইইউসিএনের কান্ট্রি অফিস যে ক’টি ব্যাঙের নাম তালিকাভুক্ত করেছিল এখন তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ছিল ২০টি, এখন ৩৬টি। এর মধ্যে ১৬টি প্রজাতি তালিকাভুক্ত করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসের পাহাড়-বনানীতে চরে বেড়ানো মায়া হরিণ শিকার করার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ায় হরিণ শিকার কমেছে।
কাটা পাহাড়ই হচ্ছে দেশীয় গাছের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।এখানে আছে বাঁশপাতা গাছ, যা দিয়ে উন্নতমানের পেনসিল তৈরি হয়। বর্তমানে বিলুপ্ত এই গাছটি কেবল চবি’র কাটা পাহাড়েই পাওয়া যায়। রয়েছে সিবিট, গড়িয়ান, গামার, গর্জন গাছ, আছে বিরল প্রজাতির অর্কিড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীর আবাসস্থল পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাই প্রশাসনের উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় সহযোগীতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে প্রাণী গবেষকদের জন্য তীর্থস্থান।
মন্তব্য চালু নেই