সোমবার বিক্ষোভ ও ছাত্র সমাবেশের ডাক
রাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ॥ এক বছরেও শেষ হয়নি তদন্তকাজ
২ ফেব্রুয়ারি। গত বছর এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এতে সাংবাদিকসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এ ঘটনায় গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। আজ ঘটনার এক বছরপূর্তি। এই এক বছরেও তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এ ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। অপরদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ।
এদিকে ঘটনার বর্ষপূর্তিতে ২ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষা বাণিজ্য প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে আজ সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্র সমাবেশের ডাক দিয়েছে ‘বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থী’ মঞ্চ।
সোমবার বিক্ষোভ ও ছাত্র সমাবেশ : শিক্ষা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে চলমান স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক আন্দোলনকে ২ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষা বাণিজ্য প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দেলনকারী শিক্ষার্থীরা। রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটোরিয়ায় ‘বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থী’ মঞ্চের ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী যারিফ অয়ন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, দিবসটি উপলক্ষে আজ সোমবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হবে। মিছিল শেষে পুনরায় গ্রন্থাগারের সামনে এসে একটি ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বর্ধিত ফি, বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্সসহ শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ, শিক্ষার্থীদের নামে করা সকল মামলা প্রত্যাহার এবং ২ ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের তিন দফা দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী উৎসব মোসাদ্দেক, রকি আহসান, প্রাণ রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আরুফুল ইসলাম, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সোহরাব হোসেন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আয়তুল্লাহ খোমেনী, বাংলা বিভাগের তামান্না তাহরিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সিহাব ইসতিয়াক সৈকত, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের আলমগীর হোসেন সুজন, অর্থনীতি বিভাগের দিলীপ রায়, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফারুক ইমন প্রমুখ।
আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন : ঘটনার এক বছর পার হলেও ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি এখনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেন নি। কবে নাগাদ তদন্ত কর্যক্রম শেষ হবে বা তদন্ত প্রতিবেদন আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাব নেই খোদ কমিটির প্রধান অধ্যাপক খালেকুজ্জমানের কাছে।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক দাবি করেন, ‘তদন্তের বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বক্তব্য জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হলেও তাদের পক্ষ থেকে আমরা কোনো সাড়া পাইনি। শুধুমাত্র ‘শত্রুপক্ষের’ বক্তব্য পেয়েছি। তাই একপক্ষের বক্তব্য শুনে তদন্ত এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না।’ এই আন্দেলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাতজন সংগঠকের সঙ্গে কথা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, তদন্ত কমিটির কোনো চিঠি তারা পায়নি।
ধরা পড়েনি অস্ত্রধারীরা : ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ছয় নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নাসিম আহম্মেদ, সাবেক যুগ্ম-সাধারণ স¤পাদক সুদীপ্ত সালাম, সাংগঠনিক স¤পাদক ফয়সাল আহম্মেদ ও শামসুজ্জামান ইমন, পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম। এর মধ্যে সুদীপ্ত সালাম ছাড়া বাকিরা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের আটক করছে না পুলিশ। নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থাও।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’
মামলা তুলে নেয়নি প্রশাসন : ২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনার একদির পর নগরীর মতিহার থানায় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চারটি মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীসহ ১৯০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে, বেআইনি সমাবেশ, মারামারি, সরকারি কাজে বাধাদান ও ভাঙচুরের অভিযোগে ২০০ জনকে আসামি করে এবং বিস্ফোরক আইনে আরও ২০০ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই অভিযোগে ৯০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনকে আসামি করে আরও দুটি মামলা করে মতিহার থানা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব মামলা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও এখনও তা তুলে নেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক উৎসব মোসাদ্দেক বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর তাদের হয়রানি করতে যে চারটি মামলা করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে সেসব মামলা প্রত্যাহারের ঘোয়ণা দেয়। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও কথা রাখেনি প্রশাসন। তারা এসব মামলা তুলে নেয়নি। বরং আন্দোলনে হামলার পরে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারও কোনো প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মু. এন্তাজুল হক বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি প্রদানের বিষয়টি আমার জানা নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এমনিতেই এই মামলাগুলোর কোনো কার্যকারিতা আর নেই।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও বিভিন্ন বিভাগে চালুকৃত সান্ধ্যকোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এতে সাংবাদিকসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ কিছু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টার জুবেরী ভবন ও বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ভবন ও হলে ভাঙচুর চালায়। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় সিন্ডিকেটের জরুরি বৈঠকে ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ ৩৬ দিন বন্ধ থাকার পর গত ১০ মার্চ থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই