রাজনীতিতে নৈতিকতা
রাজনীতির সাথে নৈতিকতা কথাটি বলতেই অনেকের ভ্রু কুচকে উঠতে পারে। রাজনীতি বড় পরিধির বিষয় এর সাথে নৈতিকতাকে জড়িয়ে দেয়া হলে বিষয়টি হালকা হয়ে যেতে পারে বলে মনে করতে পারে অনেকেই।
তাই রাজনীতি এবং নৈতিকতাকে আলোচনার টেবিলে আনতে নারাজ কেউ কেউ। রাজনীতিতে নৈতিকতা কিংবা নৈতিকতায় রাজনীতির অবস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে কেউ হয়তো কটা করে বলবে সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকে টেনে আনা এটাও এক ধরণের অপপ্রয়াস। যে যাই বলুন রাজনীতি এবং নৈতিকতা নিয়ে এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে। বর্তমান সময়ে রাজনীতি এবং নৈতিকতার বিষয়টি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিকতা সভ্যতার অন্যতম প্রতিচ্ছবি। নৈতিকতার উপর ভর করে মানুষ, সমাজ সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রগামী সমাজ নৈতিকতার দিক দিয়ে অগ্রগামী থাকে। নৈতিকতার বিষয়টি রাজনীতির অন্যতম উপাদান না হলেও রাজনীতিবিদদের জন্য নীতি নৈতিকতা অনেক সময় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। নীতিহীন নেতৃত্বের কোনো মূল্য নেই কর্মী সমর্থকদের কাছে। আর নৈতিকতা বর্জিত নেতৃত্ব আস্থাভাজন হতে পারে না আমজনতার কাছে। নীতি এবং নৈতিকতার একটা মানদণ্ড আছে। এর ব্যতয় ঘটলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রাজনীতি রাজনৈতিক দল সর্বোপরি রাজনীতিবিদদেরকে দায়ভার বহন করতে হয়। রাজনীতির পরিধি ব্যাপক হলেও নৈতিকতায় ব্যক্তি মানুষের চারিত্রিক বা সুকুমার প্রবৃত্তি প্রস্ফুটিত হয়।
রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নীতিমালা থাকলেও নৈতিকতা রাজনীতিবিদদের জন্য প্রযোজ্য। নৈতিকতা সম্পূর্ন ব্যক্তি কেন্দ্রিক। নীতিমালা ব্যক্তি-দল-বস্তু কেন্দ্রিক হয়। নৈতিকতা যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাই নৈতিকতার স্খলন কিংবা নৈতিকতা বর্জিত নেতৃবৃন্দের কারনে দলকে খেসারত দিতে হয়, দলের প্রতি বিরুপ মনোভাব তৈরী হয় সমর্থকদের । রাজনৈতিক দলগুলোকে যেহেতু জনকল্যানে কাজ করতে হয় তাই নৈতিকতার বিষয়টিতেও তাদের নজর রাখতে হয়। রাজনীতিতেও নৈতিকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইদানিং আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষ দলগুলোকে ঘায়েল করতে গিয়ে ব্যাক্তি পর্যায়ে অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের প্রতি নীতিহীন নৈতিকতা বর্জিত বক্তব্য-বিবৃতি প্রদানের মাত্রা আশংকাজনক হরে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অপ-রাজনীতির চর্চা রাজনীতিকে কুলষিত করছে। হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে একে অপরকে নিয়ে যেভাবে টিটকারি খোচা দিচ্ছে তা কখনোই রাজনীতির সুস্থ চর্চা হতে পারে না। লজ্জাজনক বলতে হচ্ছে আজ রাজনীতিতে অভিজ্ঞ সিনিয়রদের মুষ নি:সরিত যে হালকা রাসাত্মক কটাক্ষ ভাষার প্রয়োগ শোনা যায়। তাতে দেশের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা ভবিষ্যতই বলে দিবে। রাজনৈতিক বক্তব্যের নামে রাজনীতিবিদরা যে ভাষায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছে তা এখন মাঠ পর্যায়ের সীমানা ছেড়ে সংসদে গিয়ে পৌছেছে। খোদ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে নেতারা তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করতে করতে একে জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ দিতে চাচ্ছেন বলে ভবিষৎ প্রজন্ম মনে করছে। সংসদে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি হচ্ছে তাও আবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমালোচনা তাই এসব দেখে নৈতিকতা বর্জিত আচার আচরন শেখার ক্লাসে সময় নষ্ট না করে টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে ভিন দেশী নাচ গানে মাতোয়ারা হচ্ছে নবীন প্রজন্ম। কথায় আছে জল সব সময় নীচের দিকেই গড়ায়। সে মতে নেতাদের পরনিন্দা পরচর্চার সংক্রমন কর্মীদের মাঝে সংক্রমিত হচ্ছে। এটা অশুভ লক্ষন। রাজনীতিতে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারনে খুন প্রতিহিংসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হত্যা লাশ গুম এর সংখ্যার পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি স্পস্ট হয়ে উঠে। রাজনীতিতে মতোবিরোধ থাকতেই পারে ভিন্ন মত ভিন্ন দলের সমন্বয়েই বহুদলীয় গণতন্ত্র। তা না হয়ে সেখানে মত প্রকাশে বাধা দেয়া হলে প্রতিহিংসার রাজনীতি কায়েম হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য। স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকালে আজকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৈতিকতার অবক্ষয়ে কিসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়? এর শেষ কোথায় প্রশ্ন এখন অনেকেরি। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নৈতিকতার অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে শুধু রাজনৈতিক কারনে ব্যক্তি চরিত্র হননেও কন্ঠা বোধ করছেন না প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে বাবা মায়েরে দেয়া নামকে নিয়ে টিটকারি করা হচ্ছে যেমনটি গ্রামের অজ পাড়া গায়ের শিশুকিশোর তাদের বন্ধু বান্ধবকে নিয়ে করে থাকে কিংবা কাউকে অযোগ্য হেয় করতে করে থাকে ঠিক তেমনি ভাবে ইতরামি ফাতরামি এখন আমাদের রাজনীতির অপ-সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। এমনও নজির দেখা যাচ্ছে যে, বেশ কিছুদিন আগে কোন প্রবিন রাজনীতিবীদকে কটাক্ষ করার প্রতিবাদে উক্ত ভুক্তভোগী তার পতিবাদের ভাষায় পবিত্র কোরআন এর পবিত্র বাণীকে উদাহরন হিসাবে ধরে নিয়ে প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছেন। উক্ত ভুক্তভোগী মুসলমানের নাম নিয়ে কটাক্ষ করা সম্পুর্ণ ইসলাম বিরোধী বিধায় নাম নিয়ে কটাক্ষ না করার জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন। নৈাতকতার অবক্ষয়ের রাজনীতি আমারদের কোথায় নিয়ে ঠেকাচ্ছে? প্রশ্ন অনেকেরি। নৈতিকতার অবক্ষয়ের রাজনীতির কারনে মহামান্য আদালতও কথার লাগাম টেনে ধরাতে পারেনি আমাদের অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদদেরও।
নৈতিকতার অমূল্যায়নের কারনেই রাজনীতিতে হত্যা গুম প্রতিহিংসার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নীতি নৈতিকতা বর্জিত মাত্রাহীন চলমান রাজনীতির কারনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবক্ষয় ঘটছে। রাজনীতিতে নৈতিকতার অভাবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। নৈতিকতার অভাব দেশপ্রেম বাড়াচ্ছে না। আবার দেশপ্রেমের অভাবেও নৈতিকতা বাড়ছে না কারন নীতি নৈতিকতা দেশপ্রেমের পরিপূরক। অর্থাৎ সবমিলিয়ে বলা যায় রাজনীতিতে নৈতিকতা একটি মূল্যবান বিষয়। একে উড়িয়ে যাওয়া অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রাজনীতিতে নৈতিককতার অবক্ষয়ে দেশে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দূর্নীতির কালো থাবা গ্রাস করে খাচ্ছে গোটা দেশটাকে। রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিকাতার মান নিন্মমুখী হওয়ার ফলে রাজনীতির প্রতি দেশের জনগনের অস্থা, বিদেশীদের আস্থা কমে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে নৈতিকতার অবক্ষয় কখনোই রাজনীতি তথা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
রাজনৈতিক দলগুলো তার অঙ্গ সংগঠন এর নামে চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি এসবিতো নীতি নৈতিকতা চর্চার অভাবের কুফল মাত্র। রাজনীতি চলে গেছে অরাজনৈতিক ব্যাক্তিদের হাতে। কালো টাকার মালিক আমলা গড ফাদারদের কেউ কেউ নিয়ন্ত্রন করছে জাতীয় রাজনীতিকে। এ অবস্থায় রাজনীতির নৈতিকতার অধপতন হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনীতিতে জন্ম নিয়েছে সহিংসার কালচার। স্বার্থসিদ্ধির মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজনীতিতে আজ আস্থা আর বিশ্বাসের চরম সংকট অনৈতিক রাজনীতিকে প্রসারিত করছে। নৈতিকতার অভাবে শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শনের সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়ে একপক্ষ অন্য পক্ষকে শালীনতাবর্জিত মন্তব্য করতেও কুন্ঠিত হচ্ছে না। একসময় রাজনীতি-রজানীূতিবীদদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল এর বিপরিতে আজকে রাজনীতির প্রতি ভীত-অশ্রদ্ধা যে মনোভাব তার মূল কারণ রাজনীতিতে নৈতিকতার অবক্ষয় নীতি-নৈতিকতার মূল্যবোধের অভাব। এই মুহুর্তেই দেশ-জনতা রাজনীতির স্বার্থে রাজনীতিতে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। সে সাথে সততা-দেশপ্রেমের প্রতি আরো আন্তরিক হয়ে রাজনীতিতে গূনগত পরিবর্তন এনে রাজনীতিকে তার কল্যাণকর ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিতে হবে। তাহলেই রানীতির প্রতি জনগনের আস্থা বাড়বে। দেশ উন্নয়নের রাস্তা তৈরী হবে।
লেখক : সভাপতি, জিয়া সংসদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
মন্তব্য চালু নেই