রহস্যের উন্মোচন হয়নি ৩৪ বছরেও
ঘরোয়া ফুটবলে এখন গ্যালারি থাকে প্রায় ফাঁকা। বড় বা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতেও তেমনভাবে দর্শকের দেখা মেলে না। অথচ ৯০ দশক পর্যন্ত দর্শকের সমাগম ঘটত। বিশেষ করে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচ হলে তো কথাই নেই। দুপুরে ভরে যেত পুরো গ্যালারি।
ঢাকায় খেলা অথচ দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত। দুই প্রধানের ম্যাচে কত অঘটন ঘটেছে তার হিসাব মেলানো মুশকিল। তবে ১৯৮২ সালে ২১ সেপ্টেম্বরে যা ঘটেছিল তা কখনো ভুলবার নয়। সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম বিভাগ সুপার লিগে মুখোমুখি হয় মোহামেডান-আবাহনী। আবুলের নেতৃত্ব দেওয়া মোহামেডানের শিরোপা আগেই নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ ম্যাচে ড্র বা হারলে সাদা-কালোদের কিছু যায় আসত না। তাতে কি মোহামেডান-আবাহনীর লড়াইয়ে উত্তেজনার কমতি কি থাকে?
ম্যাচের শুরু থেকে কাঁপছিল গ্যালারি। একবার মোহামেডান, আরেকবার আবাহনীর আক্রমণ। যে কেউ গোল করে এগিয়ে যেতে পারে। প্রথম পর্বের ম্যাচে মোহামেডান জেতায় আবাহনীর টার্গেট ছিল প্রতিশোধের। প্রথমার্ধে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে গোল খেয়ে বসে আবাহনী। মোহামেডান এগিয়ে যায় কোহিনুরের গোলে। উৎসবে মেতে উঠে সাদা-কালোর শিবির। গোল শোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আনোয়ারের নেতৃত্ব দেওয়া আবাহনী। আক্রমণের পর আক্রমণ তা সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যায় মোহামেডানের রক্ষণভাগ। তবু গোল পাচ্ছিল না আবাহনী।
খেলা শেষ হতে তখনো মিনিট দশেক বাকি। গোলাম রব্বানী হেলাল ডি-বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক শট নেন। মোহামেডানের গোলরক্ষক মোহসিন তা দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দেন। তবে গ্যালারি থেকে মনে হচ্ছিল মোহসিন ধরার আগেই বল গোল লাইন ক্রস করে। কিন্তু রেফারি মুনীর হোসেন গোলের বাঁশি বাজাননি।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান, সালাউদ্দিন, চুন্নু, আনোয়ার ও হেলাল। কিন্তু রেফারি তার সিদ্ধান্তে অটল। তার কথা বল গোল লাইন ক্রস করলে লাইসম্যান পতাকা উড়িয়ে সংকেত দিত। আবাহনীর খেলোয়াড়রা উত্তেজিত হয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরেন। এ অবস্থায় গ্যালারিতে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠে যে রেফারিকে খেলা বন্ধ রাখতে হয়।
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসলে রেফারি উভয় দলকে মাঠে ফেরার আহ্বান জানান। কিন্তু গোলের প্রতিবাদ জানিয়ে আবাহনীর খেলোয়াড়রা মাঠে ফেরেননি। খেলা শেষ না করেই রেফারিকে তাই সেদিন মাঠ ছাড়তে হয়। এর আগেও ঢাকা লিগে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। মাঠে ফিরে না আসায় সেই দলের পুরো ২ পয়েন্ট কেটে নিয়ে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করে। অথচ ১৯৮২ সালে ২১ সেপ্টেম্বর ম্যাচে আবাহনীর শুধু পয়েন্ট কাটা হয়নি।
দেশনন্দিত চার ফুটবলার সালাউদ্দিন, চুন্নু, হেলাল ও আনোয়ারকে জেলে পাঠানো হয়। রেফারি মুনীর হোসেনও বলেছেন, এমন ঘটনায় আমিও অবাক হয়েছি। কারণ জেল খাটার মতো কোনো অন্যায় করেনি চার ফুটবলার। তখন সামরিক শাসন, রাতে মুনীর হোসেনকে চার ফুটবলারের বিরুদ্ধে নাশকতা ঘটানোর রিপোর্ট দিতে বলা হয়। অনেক ভয়ভীতি দেখানোর পরও তিনি রিপোর্ট দেননি। এরপরও চার ফুটবলারকে আসামি করে জেলে পাঠানো হয়।
সালাউদ্দিন, চুন্নু, যশোর অন্যদিকে হেলাল ও আনোয়ারকে রাজশাহী কারাগারে পাঠানো হয়। ১৭ দিন পর তারা মুক্তি পান। এ ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর বা কালো রাত্রি বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। কী কারণে চার ফুটবলারকে জেল খাটতে হলো ৩৪ বছরেও তার রহস্যের উন্মোচন হয়নি।
এ ব্যাপারে আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেন, ‘মাঠের ঘটনা নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো ফুটবলার জেল খেটেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। আমরা খেটেছি, এর পেছনে অবশ্যই কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। তা না হলে অন্যায়ভাবে আমাদের জেলে পাঠানো হলো কেন? ১৯৮২’র আগে ঢাকার মাঠে রেফারিকে মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কই তখন তো জেলতো দূরের কথা ওই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা কেন যে জেল খাটলাম সেই রহস্য এখনো ক্রীড়াঙ্গনে অজানা থেকে গেছে।’ বিডি প্রতিদিন
মন্তব্য চালু নেই