রসগোল্লা তুমি কার ?
প্রথমে ছিল বিতর্ক। তারপর শুরু হয়ে গেল আইনি লড়াই—রসগোল্লার জন্মস্থান কলকাতা না ওড়িশা? এর মধ্যে বিবিসির একটি প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো, রসগোল্লা আবিষ্কারে পটুয়াখালী অঞ্চলের মেয়েদের ভূমিকা আছে। মাথায় পোকা ঢুকে গিয়েছিল মাসুম সায়ীদের। রসগোল্লার বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন ফখরে আলমও। ছবি তুলেছেন মাসুম সায়ীদ।
‘রসের গোলক এত রস তুমি ধরিয়াছ হায়, ইতালির লোক ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।’ রসগোল্লার মাহাত্ম্য এভাবে বর্ণনা করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। রূপ লাবণ্য আর স্বাদে মিষ্টির দুনিয়ায় রসগোল্লা অনন্য। সাদা রঙেই এর আভিজাত্য ঠিকরে বেরোয়।
কী আছে রসগোল্লায়
রসগোল্লার মূল উপকরণ দুধের ছানা। গরম দুধে টকজাতীয় কিছু মেশালে দুধ ফেটে গিয়ে গুটি আকারে জমাট বেঁধে যায়। একেই বলে ছানা। এই ছানা কাপড়ে বেঁধে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফুলতে থাকে। অনেকটা মাছের ডিমের মতো। তারপর ফুলে ওঠা ছানা থেকে পানি ঝরানোর জন্য পুঁটলিটা ঝুলিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরে যাওয়ার পর অল্প খানিকটা সুজি আর পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে বানানো হয় গোলা। সেই গোলা চিনির রসে জ্বাল করা হয়। রসের ভেতর ডুবিয়ে রাখা হয় বলে নাম রসগোল্লা।
ওড়িশা খারিজ হয়
প্রাচীন ভারতে ফেটে যাওয়া দুধ বা ছানাকে অপবিত্র মনে করা হতো। বিবেচনা করা হতো অপকারী বলে। তাই দেবতাকে নিবেদন করার জন্য কোনো মিষ্টিতে ছানা ব্যবহার করা হতো না। ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ব্রাহ্মণরা ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া। তাঁরা এই অপবিত্র জিনিসকে দেবতার ভোগে ব্যবহার করতে দেবেন, এমনটা ভাবাও অসম্ভব। দুধ থেকে মিষ্টি দুইভাবে তৈরি করা যায়। এক. দুধকে ক্রমাগত জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীরে পরিণত হলে তাতে নারিকেল, চিনি বা গুড় মিশিয়ে নাড়ু ও চাকতি তৈরি করে। অন্যদিকে দুধ ফেটিয়ে ছানা করে ছানার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ সুজি বা ময়দা আর গুড় বা চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হয় সন্দেশ, মণ্ডা আর রসগোল্লা। জগন্নাথ মন্দিরে দেবতার ভোগের জন্য ক্ষীরের নাড়ু আর চাকতিই বানানো হতো। সে দিক থেকে দুধের ছানায় মিষ্টান্ন তৈরির প্রচলনটা পুরীতে নয়, বরং বাংলাতেই প্রথম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ঐতিহাসিকরা কেউ কেউ মনে করেন, মিষ্টান্ন হিসেবে ছানার ব্যবহার প্রথম শুরু করে পর্তুগিজরা বাংলাদেশের পটুয়াখালী অঞ্চলে। দুধ থেকে তারাই প্রথম পনির আর সন্দেশ তৈরি করত। তা থেকে হয়তো তাদের বাঙালি স্ত্রীরা রসগোল্লা বানানো শুরু করে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বিখ্যাত একটি রসগোল্লার দোকানের নাম ‘জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। ৬০ বছর আগে এই দোকানটি খুলেছিলেন জগবন্ধু হাওলাদার। এখানে শুধু রসগোল্লাই বিক্রি হয়। ২৫ বছর আগে জগবন্ধু মারা গেছেন। এখন তাঁর ছেলেরা দোকান চালান। জগবন্ধুর ছোট ছেলে চঞ্চল হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের একজন প্রবীণ ময়রা ছিলেন। তাঁর নাম নেপাল ময়রা। বাবা নেপাল ময়রাকে দিয়েই রসগোল্লার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। নেপাল ময়রা মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর শিষ্য শ্রীদাস ময়রা (৫৫) এখন রসগোল্লার কারিগর।’ শ্রীদাস বললেন, ‘নেপাল ময়রার পূর্বপুরুষরা রসগোল্লা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খাঁটি ছানার এই রসগোল্লা আমাদের অঞ্চলের ময়রারাই প্রথম আবিষ্কার করেছেন।’
টেকে না কলকাতাও
বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাশ বা নবীন ময়রাকে দেওয়া হয় রসগোল্লা আবিষ্কারের কৃতিত্ব। এই নবীন ময়রার ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র লেখাপড়া শিখেছিলেন। কিন্তু চাকরি না করে আত্মনিয়োগ করেন পারিবারিক ব্যবসায়। কৃষ্ণচন্দ্র আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটান রসগোল্লা তৈরি আর বাজারজাতকরণে। তাঁর আবিষ্কৃত টিনের সুদৃশ্য কৌটাজাত ‘ভ্যাকু প্যাক’ রসগোল্লাই একদিন সমুদ্র পেরিয়ে দশ দিগন্তে উড়িয়েছিল বিজয় নিশান। এটা খেয়েই আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে হয়েছিল ভেনিস বন্দরের চুঙ্গিঘরের বড় কর্তার। আর চোখ খুলেই হাত বাড়িয়েছিলেন আরো চাই। তারপর আবার! আবার! খাদ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক শওকত ওসমান বলেন, রসগোল্লা আবিষ্কারক হিসেবে কলকাতার যে নবীন চন্দ্রের নাম বলা হয়, তিনি বরিশাল অঞ্চলের লোক এবং পটুয়াখালীর কাছেই থাকতেন। (সূত্র : বিবিসি)
ডেলা থেকে স্পঞ্জ
সব শিল্পের যেমন উত্তরাধিকার থাকে, তেমনি রসগোল্লারও ছিল। রসগোল্লার আগে ছিল ছানাবড়া। নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামের হারাধন ময়রা ভালো ছানাবড়া বানাতেন। কথিত আছে, হারাধন ময়রা রানাঘাটের জমিদার পালচৌধুরীর জন্য মিষ্টান্ন বানাতেন। একদিন তাঁর শিশুকন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য উনুনের ওপর গরম রসে খনিকটা ছানা ফেলে দিয়ে দেখলেন তাতে এক নতুন জিনিস হয়েছে। আর খেতেও বেশ। তখন জমিদাররা এটার নাম করলেন রসগোল্লা। তারপর ফুলিয়া থেকে তা যায় শান্তিপুরে। শান্তিপুরের চিনির কারখানার মালিক রামকৃষ্ণ শান্তিপুর থেকে কলকাতায় গিয়ে বাগবাজারে মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণের পর তাঁর পুত্র কালিদাস ব্যবসার হাল ধরেন। ভেতরে শক্ত থাকত বলে রসগোল্লা তখন ডেলা রসগোল্লা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬০ সালে কালিদাস ইন্দ্রের দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। ১৮৬৪ সালে নবীনচন্দ্র স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন নবীনচন্দ্র । মেধাবী নবীনচন্দ্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল স্পঞ্জের মতো নরম রসগোল্লা।
রসগোল্লার বাংলাদেশ
বাংলাদেশে পুরনো মিষ্টি দোকানের মধ্যে আদি মরণচাঁদ আছে এখনো বহাল তবিয়তে। প্রায় দেড় শ বছর বয়স হলো মরণচাঁদের। কালের হিসাবে নবীন ময়রার প্রায় সমকক্ষ। টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার সূর্যকান্ত হোড়ের বয়সও প্রায় সমান।
সূর্যকান্তও দাবী রাখেন
সূর্যকান্ত হোড়ের বাড়ি ছিল ধনবাড়ীর কয়েক কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে থোরা গ্রামে। ধনবাড়ীর নবাব ছিলেন তখন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। পহেলা বৈশাখের দিন নবাববাড়ির সামনে মেলা বসত। মেলায় মিষ্টির দোকান খুলে বসেছিলেন সূর্যকান্ত হোড়। মিষ্টির স্বাদে অভিভূত নওয়াব বাহাদুর ডেকে পাঠান সূর্যকান্তকে। প্রণাম করে নবাবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ান সূর্যকান্ত। নবাব তাঁকে গ্রাম থেকে বাড়িঘর তুলে এনে স্থাপন করতে নির্দেশ দেন নবাববাড়ির পাশে। সে কত কালের কথা! বাড়িটা এখনো সেখানে থাকলেও বংশধররা বলতে পারে না দিন-তারিখ। নবাব জনাব আলী চৌধুরী অকালে ইন্তেকাল করায় খুব অল্প বয়সেই নবাবি পেয়েছিলেন নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী। তাঁর সময়কাল ১৮৬৩ থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ। সূর্যকান্ত হোড়ের বাবা ধরণীকান্তও রসগোল্লা বানাতেন। এই ধরণীকান্ত কবে, কোথা থেকে রসগোল্লা বানানো শিখেছিলেন, সে ইতিহাস অজানা। কালের হিসাবে তার কাল নবীন ময়রার চেয়েও পুরনো।
জোর দিয়ে বলছেন অধ্যাপক জাহিদ
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান জাহিদ বলেন, ‘এই উপমহাদেশে প্রথম বরিশাল অঞ্চলে পর্তুগিজরা এসে ছানা তৈরি করে। সেই ছানা থেকেই রসগোল্লা আবিষ্কার হয়। কাজেই আমরা বলতে পারি, বরিশালই রসগোল্লার উত্পত্তিস্থল। কলকাতা, ওড়িশা নয়—বাংলাদেশেই প্রথম রসগোল্লা তৈরি হয়েছিল। এর পক্ষে আরো যুক্তি হচ্ছে, গরুর দুধের ছানায় সবচেয়ে ভালো রসগোল্লা হয়। বরিশাল অঞ্চলে একসময় গরু আর মহিষের দুধের ছড়াছড়ি ছিল। এই দুধের ছানা দিয়েই প্রথম রসগোল্লা তৈরি হয়, যা আমরা জোরেশোরেই বলতে পারি।’
‘রসগোল্লা আবিষ্কারক বরিশাল অঞ্চলের লোক’
শিরোনামে বিবিসি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার পর তার ফেসবুক পাতায় অনেক মন্তব্য জমা হয়েছে। তার মধ্যে নির্বাচিত কয়েকটি
আরিফুল ইসলাম : যাক, সত্যটা বের হয়ে এসেছে। আমি বলতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশে প্রথম রসগোল্লা তৈরি হয়েছে; কিন্তু ঝগড়াটা দেখব বলে বলিনি।
পাপ্পু ভট্টাচার্য : এটা সুসংবাদ এবং আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। মিষ্টি ছাড়া আমরা কোনো অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করতে পারি না।
কে এম আখতারুজ্জামান মামুন : মোর আগেই মনে হইছে মোরা ছাড়া এই জিনিস কেহ বানায় নাই (সংক্ষেপিত)।
মো. সালাউদ্দিন ইমন : এ জন্যই তো বলি, রসের মধ্যে গোল্লা দিয়ে যে মজা করে খাওয়া যায়, এই বুদ্ধি বরিশালের লোক ছাড়া কার মাথায় আসতে পারে?
মো. ইউসুফ আলী : রস আর গোল্লা, বরিশাল এগিয়ে যাচ্ছে, সব বাধা উপেক্ষা করে দিয়ে পাল্লা।
এস এম জামান : আজকেও চারটে চেখে দেখলাম। খবরটা শুনে একটা দীর্ঘ তৃপ্তিকর ঢেকুর তুললাম।
মন্তব্য চালু নেই