রমা থেকে সুচিত্রা সেন
সবুজ শ্যামল ছায়া ঢাকা আমাদের এই বাংলা। এই দেশের মাটিতেই জন্ম নিয়ে অভিনয় জগৎটা যে মহামানবী সমৃদ্ধ করেছেন তিনি রমা দাশ, যে কিনা আজকের সুচিত্র সেন। রমা দাশগুপ্ত থেকে কিংবদন্তি সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। সুচিত্রা মূলত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাইতো ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। এই বাঙালি অভিনেত্রীকে ১৯৭২ সালে ভারত সরকার সে দেশের সর্ব্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী পদক প্রদান করে।
জন্ম
রমা দাশ ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। রমা ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পাবনা শহরেই তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। তার আরো একটি পরিচয় হলো তিনি কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।
যেভাবে সুচিত্রা হয়ে ওঠা
বাবার বড় আদরের মেয়ে ছিলেন রমা। তাই বাবা নিজেই তাকে বাড়িতেই আদর করে পড়তে বসাতেন। ছোটবেলায় লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালোই ছিলেন। তার পড়ালেখার জীবনটা পাবনাতেই শুরু হয়। তবে পাটনায় মামার বাড়িতেও কিছুদিন থেকেছেন। সেখানেই এক নাগা সন্যাসী তিন বছরের ছোট্ট রমাকে দেখে বলেছিল, মেয়েটি সুলক্ষণা। বড় হলে ওর নাম ডাক হবে। কথাটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছিল। দেশভাগের সময় রমা চলে যান ভারতে। তবে বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই পাবনা ছেড়ে কলকাতায় শান্তি নিকেতনের পাশে ভুবনডাঙ্গায় উঠেছিলেন।
অসামান্য সুন্দরী হওয়ায়, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রিয়নাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে রমার বিয়ে হয়। অনেকটা জেদের বশেই বিয়েটা করেছিলেন। কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। তখন ‘সাত পাকে বাধা’ ছবির শুটিং চলছিলো। ছবিতে সুচিত্রা রাগ করে অভিনেতা সৌমিত্রের জামা ছিঁড়ে দিয়েছেন এমন একটি দৃশ্য ছিলো। ভাগ্যের কি পরিহাস এই দৃশ্যটির শুটিং যেদিন ছিলো, ঠিক সেদিন সকালে কথা কাটাকাটির জেরে স্বামীর জামা ছিঁড়ে বাড়ি ছেড়ে সোজা চলে এসেছিলেন শুটিংয়ে। অথচ রমার চলচ্চিত্রে নামা কিন্তু তার নিজের ইচ্ছায় নয়। স্বামী দিবানাথই জোর করেছিলেন তিনি যাতে অভিনয়টা করেন। চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফেল করেছিলেন সকলের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। অবশ্য তখনও তিনি রমা সেন। ততদিনে জেদ চেপে বসেছে। অভিনেত্রী হবেনই। পরে অবশ্য স্ক্রিন টেস্টে উতরে গিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ এর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তার চলচ্চিত্র জীবন। কিন্তু সেই ছবি মুক্তি পায়নি। সুচিত্রার মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’(১৯৫৩)। এই ছবিতেই রমা দাশ পরিবর্তিত হয়েছিলেন সুচিত্রা সেনে। ছবির পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারি নীতিশ রায়ই রমার নতুন নামকরণ করেছিলেন। তবে উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটিই ব্রেক এনে দিয়েছিলো তাকে। তারপর থেকে সুচিত্রা সেন নিজের জেদ ও অধ্যাবসায়ে বাঙালির হৃদয়ের রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে। আর এই ছবিটিই তার জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে একের পর এক সাড়া জাগানো ছবিতে অভিনয় করেছেন।
‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘হারানো সুর’, ‘সাত পাকে বাধা’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘সাগরিকা’, ‘সপ্তপদী’ এমনি অসংখ্য ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় তার সময়কে ছাপিয়ে গিয়েছিলো। আর তাই তিনি সহজেই কিংবদন্তী নায়িকাতে পরিণত হয়েছিলেন।
সেরা জুটি
সুচিত্রা সেন উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরীর মতো নায়কদের বিপরীতে আভিনয় করেছেন। কিন্তু সুচিত্র-উত্তম জুটির রোমান্স এতটাই স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ ছিলো যে, কখনোই তা অভিনয় মনে হয়নি। দুজনের এই রসায়নের কারণেই মেয়ে মুনমুন সেন পর্যন্ত একবার মাকে বলেছিলেন, মা তোমার উত্তমকুমারকে বিয়ে করা উচিত ছিলো। শুনে সুচিত্রা শুধু হেসেছিলেন। আসলে সুচিত্রা-উত্তমের মধ্যে যে প্রবল আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলচ্চিত্রে রুপ পেয়েছে তা আগে কখনো হয়নি। আর তাই সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত বলেছেন, পৃথিবীতে খুব কম জুটি আছে যাদের মধ্যে বন্ডিংটা এতো ম্যাজিকাল। সুচিত্রা সেন উত্তকুমারের সঙ্গে সর্বমোট ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার মনোনীত হন, ১৯৭২ চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন, ১৯৭৬ সালে আবারো ফিল্মফেয়ারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন, ২০১২ বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন।
মৃত্যু
১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিটি দর্শক ভালভাবে না নেওয়ায় সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্রকে বাই বাই জানাতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। তার ধারণা হয়েছিলো দর্শকের প্রত্যাশা আর পূরণ করতে পারবেন না তিনি। সেই থেকেই তিনি চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তবে তার ইচ্ছে ছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ নিয়ে কোন ছবি হলে তাতে ‘দামিনী’ চরিত্রে অভিনয় করবেন। একবার কথা পাকা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু প্রযোজক হঠাৎ আত্মহত্যা করায় সেই ছবি আর করা হয়নি। এই একটি ব্যাপারে তার আফসোস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। এমনকি ‘চতুরঙ্গ’ নিয়ে কেউ যদি নাটক নির্মাণ করেন তাতেও তিনি অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। সেই সাধ অপূর্ণ রেখেই অভিনয় জীবনের বেশ কিছু বছর অলক্ষে কাটিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান সুচিত্রা সেন।
মন্তব্য চালু নেই