যে নারী আলোয় আসতে পারে না
২০০৫ সাল। এপ্রিল মাসের কোনো একদিন। প্রতিদিনের মত অফিসে বসে কাজ করছেন অ্যানা। ডেস্কে বসে কিছু একটা লিখছিলেন তিনি। সামনে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে একটা ছবি ভেসে ওঠলো। স্ক্রিনের আলো এসে পড়ল তার মুখের ওপর। হঠাৎ করেই চমকে উঠলেন অ্যান। মনে হচ্ছে যেন আগুন লেগেছে-মুখটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। দ্রুত কম্পিউটারের সামনে থেকে সরে এলেন। সেই শুরু। এরপর কেটে গেছে আরো কত বছর। গত দশ বছর থেকে অন্ধকার একটি ঘরে বন্দী জীবন যাপন করছেন ৪৩ বছরের অ্যানা।
আলোর সঙ্গে আড়ি তার। তাই সূর্যের আলো এড়াতে সারাদিন এক অন্ধকার ঘরে বসে থাকেন। শুধু সূর্য নয়, সবধরণের আলোই যেন তার শত্রু । তাই টেলিভিশন দেখেন না-কম্পিউটারেও বসা হয় না আর। দিনে দিনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কখনো কখনো এমন হয় যে, মাসের পর মাস ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ফলে গত দশ বছর ধরে অন্ধকারেই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন পিয়ানোবাদক এই নারী।
এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো কারণ বা চিকিৎসা খুঁজে বের করতে পারেননি ব্রিটিশ চিকিৎসকরা। ফলে বাধ্য হয়ে অন্ধকারের কাছেই আশ্রয় খুঁজেছেন লন্ডনে বসবাসকারী এই নারী। কিন্তু এ নিয়ে অ্যানার খুব কষ্ট। মাঝে মাঝে তার হাড়ের ওপর থেকে চামড়াটাকে নখ দিয়ে টেনে তুলে ফেলতে ইচ্ছে হয় । ঘরের মধ্যেও কি স্বাভাবিক থাকার উপায় আরছে তার! ঘরেও বিশেষ এক কোম্পানির তৈরি বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হয়। নাইলনের তৈরি ওই পোশাকের ভিতর দিয়ে কোনো রশ্মি তার শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। অ্যানা ওই বিশেষ পোশাক দিয়েই ঢেকে রাখেন গোটা শরীর। এমনকি মাথায়ও পরতে হয় টুপি।
কিন্তু গ্রীষ্মকালে খুব কষ্ট হয় অ্যানার। বাড়ির সবচাইতে শীতল ঘরে বসেও কুলকুল করে ঘামতে থাকেন। কষ্ট কমাতে কখনোবা মেঝেতে শুয়ে থাকেন। তারপরও বাতাসের জন্য খিড়কিটা একটু ফাঁক করার সাহস হয়না । তখন কান্না করেন অসহায় অ্যান। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে বেশ কয়েকটা বরফের বোতল চারপাশে রেখে দেন। নিজেকে তখন মৃত মানুষ বলেই মনে হয়। মৃতদেহ তাজা রাখতেই তো এভাবে বরফের মধ্যে রাখা হয়!কখনো কখনো আত্মহত্যা করার কথাও ভাবেন অ্যান। কিন্তু তার যে বড্ড বেশি বাঁচতে সাধ হয়। তাই বুঝি অতি তুচ্ছ জিনিসের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন। বসন্তের ডেফোডিল ফুল, শুকনো পাতা আর বাগান থেকে ভেসে আসা ভেজা গন্ধ এ সবই তার খুব প্রিয়। খুব ইচ্ছে করে, একদিন ভোরবেলা ধুলার ভিতর হেঁটে যাবেন কোনো অজানা পথ ধরে। কিন্তু এই স্বপ্ন কোনোদিন বাস্তব হবে কীনা তা জানা নেই তার। তারপরও স্বপ্ন দেখেন। এক্ষত্রে তাকে সাহস যুগিয়ে থাকেন স্বামী পিটার। তিনি আত্মহত্যা করতে চাইলে পিটার বলেন,‘তুমি আমার জন্য বেঁচে থাকবে। আমি তোমাকে কখনোই মরতে দিব না।’ এরপর দু হাতে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেন অ্যানাকে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের এক শীতল, ছায়াচ্ছন্ন দিনে অ্যানির সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছেন পিটার। তিন মাস আগেই তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাদের বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে বিয়ে করলেও অসুস্থতার কারণে মা হতে পারছেন না অ্যান।
শুধু পিটার নয়-আরো একটি বিষয় তাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেটি হচ্ছে তার আত্মজীবনী। বেশ কয়েক বছর ধরে এটি লিখতে শুরু করেছেন অ্যানা। ‘গার্ল ইন দা ডার্ক’ বইটির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে নিজের এই অদ্ভূত অসুখের কথা। লেখালেখি করতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি তার। হয়তবা দীর্ঘদিন অন্ধকারে থাকার কারণেই অন্ধকারের মধ্যেই লেখার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। তিল তিল করে নিজের সুপ্ত কষ্ট, ভালোবাসা আর স্বপ্ন মালার মত করেই সাজিয়েছেন এই বইটির প্রতি পাতায়।
সম্প্রতি অ্যানা লিন্ডসের ‘গার্ল ইন দা ডার্ক’ বাজারে এসেছে। এটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যে ব্লুমসবেরি প্রকাশনী।
মন্তব্য চালু নেই