যে কোনও ধর্মেই নারীর কুমারীত্ব গুরুত্বপূর্ণ কেন? জানলে অবাক হবেন…
ভার্জিন মেরি অথবা কুমারী পূজার কুমারী— বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা ধর্মমতে কুমারী নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। কেন? দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত লিখেছিলেন বিষয়টি নিয়ে।
ভার্জিন মেরি অথবা কুমারী পূজার কুমারী— বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা ধর্মমতে কুমারী নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। কেন? দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত লিখেছিলেন বিষয়টি নিয়ে। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গোল্ডেন বাও’ গ্রন্থে সমাজ-নৃতাত্ত্বিক জেমস ফ্রেজার বিষয়টির উপরে আলোকপাত করেছিলেন ধর্মের কৃষি ও প্রজনন-ভিত্তিক উৎসের নিরিখে। তাঁদের মতে, কুমারীত্ব সম্পর্কে ধর্মের গুরুত্ব ‘ধর্ম’-এর উদ্ভবের চাইতেও প্রাচীন। অর্থাৎ, প্রজনন-ভাবনা থেকে যখন মানুষ টোটেম তৈরি করে প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা শুরু করেছে, তখন থেকেই কুমারী নারীকে যাবৎ সম্ভাবনার আধার হিসেবে মনে করা হত। মনে করা হত, তারাও উপাস্য। এই ভাবনা থেকেই দেবীশক্তির কিছু বিশেষ কাল্ট জন্ম নেয়। দেবীপ্রসাদের গবেষণায় শাকম্ভরী উপাসনা বা পার্বতীর কল্প এই কুমারী-ধারণা থেকেই জাত।
বিশেষ করে, খ্রিস্টীয় ও হিন্দু ধর্মে নারীর কুমারীত্বকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। কুমারী মেরির ধারণা তো সেই কথাই বলে। প্রাচীন গ্রিকদের পৌত্তলিক ধর্মেও প্রবল গুরুত্ব ছিল কুমারী নারীর। মনে করা হতো কুমারীরাই দেবতাদের রোষকে প্রশমিত করতে পারে। ইউরোপের প্রাচীন উইক্কা ধর্মেও কুমারীত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরে উইচক্র্যাফ্ট বা ডাকিনীবিদ্যাতেও প্রবেশ করে এই ধারণা। ‘ভার্জিন স্যাক্রিফাইস’-এর মতো নিষ্ঠুর বলিদান প্রথা ব্ল্যাক মাজিকের একটি অঙ্গ হিসেবে মাথা চাড়া দেয় মধ্যযুগে। ক্যাথলিক চার্চও কুমারীত্বের পবিত্রতার উপরে বিপুল গুরুত্ব আরোপ করে। অবিবাহিতা মেয়েচের যৌনাচারের উপরে বিপুল নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। প্রাক-বিবাহ যৌনাচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। এবং সেই শাস্তির চরিত্র কী মারাত্মক। তা মধ্যযুগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেই জানেন।
হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মচর্যের পবিত্রতাকে বিপুল গুরুত্বের সঙ্গে দেখা সহয়। নারীর ব্রহ্মচর্যের সঙ্গে কুমারীত্বের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুমারীত্ব এখানে পবিত্রতার সমার্থক। টোটেমের যুগ থেকে চলে আসা বহু আচার ও বিশ্বাসকেই বহন করে হিন্দু ধর্ম। সেই সূত্রে কুমারীত্বকে বিশেষ শক্তির আধার বলেও মনে করা হয়। কুমারী পূজার উৎসও এই বিশেষ বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত।
আজ কুমারীত্বকে, বিশেষত নারীর শারীরিক কুমারীত্বকে পবিত্র হিসেবে দেখার ব্যাপারটা বিপুল প্রশ্নের সামনে। মানবীচেতনাবাদীরা এই ধরনের গুরুত্বকে অহেতুক বলে দেখান। সেই সঙ্গে তাঁদের ধারণায় কুমারীত্বকে পুরুষতন্ত্র তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। তার জয়গান গাওয়া আসলে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতাকেই কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে। হয়তো তাই। হয়তো নয়। কিন্তু কুমারী-উপাসনার এই আদিম ঐতিহ্য থেকে আজও তো নিস্তার মেলেনি সভ্যতার! সেই সত্যকে অস্বীকার করার কোনও উপায় আছে কি?এবেলা
মন্তব্য চালু নেই