যে কারণে হেফাজতের আস্থায় আ.লীগ
দাবি পূরণ ও সরকারের নমনীয় আচরণের কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা ফিরেছে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের। গত মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য অপসারণের আশ্বাস ও হেফাজতের দাবি মেনে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনেও আমন্ত্রণ পেয়েছেন কওমিপপন্থী হেফাজতের আমির ও তার অনুসারীরা। সব কিছু বিবেচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা বেড়েছে হেফাজতে ইসলামের। সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব জানা গেছে। যদিও তারা প্রকাশ্যে আস্থার বহির্প্রকাশে যথেষ্ঠ কৌশলী।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন,‘কওমি স্বীকৃতির ঘোষণার ফলে সরকার যদি ইসলামবিরোধী ভূমিকা রাখে, তবে তার বিরুদ্ধে হেফাজতের আন্দোলনমুখী হতে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ইসলাম ধর্মের মর্যাদা রক্ষায় হেফাজতের বিদ্যমান আন্দোলন চলতে থাকবে। ঈমানি আন্দোলনের প্রশ্নে কোনও আপস নেই। কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা ও প্রক্রিয়ায় শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ওলামায়ে কেরামরা ভূমিকা রেখেছেন। সুতরাং হেফাজতে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনও সুযোগ নেই।’
মাওলানা আজিজুল হক বলেন,‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধ যেমন নেই, তেমনি আপোষের বিষয়ও নেই। হেফাজত রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার কোনও আন্দোলন করছে না। ধর্ম নিয়ে কোনও বির্তকিত ঘটনা ঘটলে হেফাজত আগের মতোই সক্রিয় থাকবে।’
হেফাজত সূত্রে জানা গেছে, ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে তাণ্ডবের মামলার আসামি হেফাজত নেতারা। এসব মামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে কিছুটা কৌশলী হেফাজত নেতারা। গণভবনে কওমি সনদের স্বীকৃতি ছাড়াও মামলা প্রত্যাহারে বিষয়টিও উঠে এসেছে কওমিপন্থী হেফাজত নেতাদের বক্তব্যে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের আহবায়ক নূর হোসাইন কাসেমীসহ বিভিন্ন নেতারা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের আমির ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের(বেফাক) সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তার নেতৃত্বে গণভবনে গিয়েছেন প্রায় ৩০০ জন আলেম। বৈঠকে কওমি আলেমদের উপস্থিতিতে
আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। আহমদ শফীর দাবি মেনে কওমি মাদ্রাসার দাওয়ারে হাদিসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তোলা হলে তাতেও সায় দেন প্রধানমন্ত্রী।
হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্যতাকে ভালো চোখে দেখছে না বিএনপি। কওমিপস্থী কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিএনপি জোটেরও শরিক দল। তবে বিএনপি জোটের শরিক দলের নেতা হয়েও কয়েকজন কওমিপন্থী নেতা যোগ দিয়েছেল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমীসহ দলটির বেশ কয়েকজন নেতা যোগ দিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। যদিও দলটির দাবি, বেফাকের সহ-সভাপতি হিসেবে সে অনুষ্ঠানে গিয়েছেন নূর হোসাইন কাসেমী।
প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন বলে গত ১২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কওমি সনদের স্বীকৃতি নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘২০০৬ সালে কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতি আমাদের সরকার দিয়েছিল। গত ১১ বছরে মাদ্রাসাবিরোধী সরকারগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বিষয়টি আর এগোতে পারেনি। দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতিকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য শেখ হাসিনা ভারত সফরের আগে আলেম সম্মেলন করেন। ফিরে এসে আবার হেফাজতে ইসলাম প্রভাবিত কওমি মাদ্রাসার ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলেমদের সঙ্গে তার অতীত আচরণ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আঘাতের কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। ’
তবে সরকারের সঙ্গে কোনও আপস নেই বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজত নেতা ও বেফাকের সহকারী মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, ‘কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। আলেমরা সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতায় কোন দল সেটি মুখ্য বিষয় নেই। দেশের একটি বৃহৎ অংশ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে কওমি মাদ্রাসার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মানে এই নয় সরকারের সঙ্গে কোনও আপস হয়েছে। এখানে আপস বা বিরোধের প্রশ্ন অবান্তর।’
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘সব পক্ষ থেকে উদারতার পরিচয় দেওয়া দরকার। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা দরকার। যারা ইসলামের পক্ষে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক থাকে। সব পক্ষকে বুঝতে হবে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান। ইসলামি জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে কেউ যদি মনে করে অনেক কিছু অর্জন করবে, তবে সেটা দিবাস্বপ্ন হবে। মুসলমানদের দাবির পক্ষে অবদান রাখতে হবে। বর্তমান সরকারও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে, তারা তাদের অবদান রাখছে। তাদের বর্তমান ভূমিকা তাই বলছে।’
তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপসের কোনও বিষয় নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ১৩ এপ্রিল দলের সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি। আর হেফাজতের সঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে আলাপও করতে যাইনি। বাংলাদেশের ৭০ হাজার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদেরতো আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না।’
মন্তব্য চালু নেই