যেভাবে একজন ভ্যানচালক থেকে বিশ্ব দরবারে গেলেন হেমায়েত

ছোট্ট হেমায়েত মোল্লা যখন মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম ক্যারামের স্ট্রাইক হাতে নেন, তখন তার লক্ষ্য ছিল ক্যারাম বোর্ডের সবগুলো গুটিকে পকেটবদ্ধ করা। এখন তিনি বিশ্ব দরবারে যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তখনো তার লক্ষ্য একই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অশিক্ষিত, ভ্যানচালক, গ্রামের ছেলে হেমায়েতের বিশ্বজয়ের গল্প শোনাচ্ছেন আহসান রনি

খুলনা জেলার বাগেরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হেমায়েত। বাবা ভ্যানচালক। বাবার সেই সামর্থ ছিল না যে ছোট্ট হেমায়েতকে তিনি লেখাপড়া শেখাবেন। ফলে হেমায়েত স্কুলে না গিয়ে পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে, বন্ধুদের সাথে মজা করে আর খেলাধুলা করে সময় কাটাত তার। বয়স যখন ১২, এলাকার ছেলেদের কাছ থেকে ক্যারাম নামের চির পরিচিত গ্রাম্য খেলাটি শিখে ফেলেন হেমায়েত।

প্রথমে ভালোলাগা, তারপর ভালোবাসা। ক্যারাম হয়ে যায় তার জানপ্রাণ। খেলা শেখার ঠিক এক বছরের মাথায় হেমায়েত ক্যারামে হারিয়ে দেন এলাকার সবচেয়ে বড় ক্যারাম খেলোয়াড়কে। ছোট্ট হেমায়েতের নাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। গ্রামে ক্যারামের বাজি খেলা হতো। আর বাজি খেলা হলেই ডাক পড়ত হেমায়েতের। সকলকে হারিয়ে পুরস্কার হিসেবে কখনো টিভি, কখনো ছাগল ঘরে তুলতেন তিনি! এভাবেই শুরু। কিন্তু শুধু ক্যারাম খেললেই তো পেট ভরবে না। তাই কাজের খোঁজে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাগেরহাটের হেমায়েত চলে আসেন ঢাকায়।

অশিক্ষিত ছেলেটি স্কুলের ভ্যানচালানোর চাকরি পায়। কিন্তু ক্যারামের ভূত তখনো নামেনি অথবা তার পরিচিতরা নামতে দেয়নি। বড় কোনো খেলা হলেই ডাক পড়ত তার, আর ঢাকায় মাঝে মাঝে বিভিন্ন ক্যারাম বোর্ডে খেলতে গিয়ে চমকে দিয়ে আসতেন! ২০১১ সাল থেকে তার জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। সেবার হেমায়েতকে খুলনায় খেলার জন্য ডাক দেওয়া হয়। ঢাকা থেকে খুলনা খেলতে যান তিনি। সারাদেশ থেকে খেলতে আসা সকল খেলোয়াড়দেরকে হারিয়ে দিয়ে এবারও চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার ঘরে তোলেন। সেখানেই পরিচয় হয় মনির নামের জাতীয়ভাবে ক্যারাম খেলা এক খেলোয়াড়ের সাথে।

হেমায়েত প্রথম জানতে পারেন ক্যারাম একটি জাতীয় খেলা এবং প্রতিবছর অনেকগুলো ক্যারাম প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু খেলার ধরন আলাদা। বসে খেলতে হয়, স্ট্রাইক আর গুটিও আলাদা, অনেক নিয়মকানুন। মনির পরিচয় করিয়ে দেন মোহাম্মদ আলীর সাথে। মোহাম্মদ আলী জাতীয় ক্যারাম দলের সদস্য। তিনি হেমায়েতের নাম আগেও শুনেছেন, সরাসরি পরিচিত হয়ে তার খেলা দেখে মোহাম্মদ আলী তার নাম দিয়ে দেন ক্যারাম ফেডারেশন আয়োজিত বাছাইপর্বে। সেই বাছাইপর্বে সবাইকে একেরপর এক চমক দেখিয়ে রানার্সআপ হন হেমায়েত।

‘ক্যারাম ফেডারেশন’ আয়োজিত ২০১২ সালের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। এরপর আর তাকে ঠেকায় কে। সে বছর সার্ক টুর্নামেন্টের বাছাইপর্বে প্রথম হন এবং সার্ক টুর্নামেন্টের মূল প্রতিযোগিতায় তার অসাধারণ কৃতিত্বে বাংলাদেশ তৃতীয় হয়। তিনি সেই টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কার চ্যাম্পিয়ন এবং বিশ্ব র্যাংকিংয়ের পাঁচ নম্বর খেলোয়াড়কে হারিয়ে দেন। এরপর এই ভ্যানচালককে পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কায় আয়োজিত ‘হল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ। ১৮ দেশের সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান অধিকার করার পেছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব ছিল হেমায়েতের।

পরবর্তীতে দেশে আয়োজিত সবগুলো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নের জায়গায় নামটি হেমায়েত মোল্লা। সার্ক থেকে ক্যারামের র্যাংকিং করা হলে হেমায়েতের স্থান হয় ছয় নম্বরে। ২০১৪ সালে মালদ্বীপে আয়োজিত হয় ক্যারাম বিশ্বকাপের। ভারত ও শ্রীলঙ্কার ‘সম্পূর্ণ প্রফেশনাল খেলোয়াড়’-দের সাথে অসাধারণ খেলে এবারও ‘শুধুমাত্র টুর্নামেন্ট খেলা’ বাংলাদেশ দল তৃতীয় স্থান অধিকার করে। ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং প্রকাশ করা হলে চমকে ওঠে বাংলাদেশ।

বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ৮ম স্থানটির পাশে দেশের নামের ঘরে লেখা বাংলাদেশ এবং নামের ঘরে লেখা সেই বাগেরহাটের অশিক্ষিত ভ্যানচালক হেমায়েত। হেমায়েত জানালেন, যদিও তিনি নিজের নাম বিশ্বসেরাদের কাতারে পড়তে পারেননি; কিন্তু যখন শুনেছেন তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠেছে। ক্যারাম ফেডারেশনের সভাপতি জুনায়েদ আহমেদ পলক এই গরিব ভ্যানচালকের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার গল্প শুনে তাকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে সাহায্য করেছেন।

কিন্তু বাংলাদেশ ক্যারাম ফেডারেশন এখন পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড়ের পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো সবল হতে পারেনি। ফলে টুর্নামেন্টের সময় শুধু ঠিকমতো প্র্যাকটিস করার সুযোগ হয় হেমায়েতের। বাকি সময়টা তাকে অন্ন সন্ধানেই ঘুরতে হয়।

তাই হেমায়েত স্বপ্ন দেখেন সরকার ক্যারামকে আরেকটু গুরুত্ব দেবে এবং এমন ব্যবস্থা করবে যাতে করে তাকে আর অন্নের সন্ধানে বাইরে ঘুরতে হবে না। তিনি মনপ্রাণ দিয়ে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাবেন এবং বিশ্বের নম্বর ওয়ান হওয়ার জন্য এগিয়ে যাবেন।

হেমায়েতের টিম ম্যানেজার আশরাফ আহমেদ লিয়ন জানান, তারা সবসময় চেষ্টা করেন হেমায়েতকে সাহায্য-সহযোগিতা করার। কিন্তু তা দিয়ে তার সংসার চলে না। তাকে একটা চাকরি দেওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে কিন্তু সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। লিয়ন বিশ্বাস করেন, হেমায়েতকে যদি তার পরিবারের জন্য অন্ন সংস্থানের চিন্তা না করতে হয় এবং তিনি যদি মনে প্রাণে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পান তাহলে একদিন সারা বিশ্বের ১ নম্বর র্যাংকিংয়ে থাকবে হেমায়েতের নাম, বাংলাদেশের নাম।



মন্তব্য চালু নেই