যেখানে-সেখানে এজেন্ট, আক্রমণের শিকার বিকাশকর্মী
দেশজুড়ে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে টাকা পাঠাতে ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মুদি কিংবা স্টেশনারি দোকান অথবা ফুটপাতে মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাক্সিলোডের ‘টেবিলে’ দিব্বি এজেন্সি খুলে বসা যায়। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের সেখানে-সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে টাকা আদান-প্রদানের এ ব্যবসার ‘দোকান’।
অরক্ষিত এসব দোকানে প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের টাকার লেনদের হয় বলে প্রায়ই দুর্বৃত্তদের হামলার মুখে পড়েন বিকাশকর্মীরা। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের আগে টাকা লেনদেন বেড়ে গেলে হামলার ঘটনাও বেড়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ে না কিংবা উদ্ধার হয় না লুট হওয়া টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম বেশ কয়টি ঘটনায় হতাহত হয়েছেন কয়েকজন বিকাশকর্মী। এর মধ্যে গত এক মাসে চারটি ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন। এ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, বিকাশকর্মী ও এজেন্সির কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু সেগুলো তেমন প্রচারে আসে না।
গাজীপুরের টঙ্গীতে সোমবার দিন-দুপুরে এক বিকাশকর্মীকে গুলি করে হত্যার পর টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওই কর্মীর নাম শেখ আবদুল হামিদ।
পুলিশ জানায়, সোমবার বিকাল তিনটার দিকে টঙ্গীর গাজীপুরা এলাকায় মা মাল্টিমিডিয়া নামের একটি দোকানে বসে বিভিন্ন দোকান থেকে সংগৃহীত টাকা গুনছিলেন আবদুল হামিদ। এ সময় আট-দশজন দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেলে এসে তাকে গুলি করে। মাথা ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন হামিদ। এরপর দুর্বৃত্তরা তার টাকার ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে পাঠায়।
টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ফিরোজ তালুকদার বলেন, এ ঘটনায় টঙ্গী থানায় একটি মামলা হতে যাচ্ছে।
এর আগে রবিবার সাভারের আশুলিয়া এলাকায় দুই বিকাশকর্মীকে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুবর্ৃৃত্তরা। আহত দুই বিকাশকর্মী শুভ ও জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শুভর মামা আদিল জানান, শুভ ও জাহাঙ্গীর মোটরসাইকেল করে এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা তুলে আশুলিয়ার বিকাশ অফিসে যাওয়ার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাদের গতি রোধ করে। এরপর তাদের দুজনের পায়ে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালায় দুর্বৃত্তরা।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহাসিনুল কাদির বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি।
গত আগস্ট মাসে ১০ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে ঘটে এ রকম আরও দুটি ঘটনা। ১০ আগস্ট সাভারের আমতলার সোবাহানবাগ এলাকায় মনিরুজ্জামান (৩৮) নামের এক বিকাশকর্মীকে প্রকাশ্যে গুলি করে দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আহত বিকাশকর্মী মনিরুজ্জামান জানান, তিনি আমতলা এলাকায় ইবাদত ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন দোকান থেকে দুই লাখ টাকা তুলে হেঁটে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দেন।
এ সময় পেছন থেকে আসা তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন তাকে ধরে পেটে ও পায়ে গুলি করে দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে মনিরুজ্জামানকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে স্থানীয় লোকজন।
দ্বিতীয় ঘটনায় ২৫ আগস্ট রাজশাহীর কাপাশিয়া এলাকার বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমির সামনে বিকাশের দুই কর্মীকে গুলী করে তিন লাখ টাকা ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ দুই বিকাশকর্মী হলেন রবিউল ইসলাম ও মমিনুল ইসলাম। দুজনই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মমিনুল ইসলাম দাবি করেন, তাদের ব্যাগে থাকা ১২ লাখ টাকার মধ্যে তিন লাখ টাকা নিতে পেরেছে ছিনতাইকারীরা।
এভাবে প্রায় প্রতি মাসেই দেশের কোথাও না কোথাও বিকাশকর্মীদের গুলি করে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনার প্রায় সব ক্ষেত্রেই থানায় মামলার নজির খুব কম। ফলে পুলিশের কাছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
ধর্মীয় বড় উৎসব ঈদ-পূজা কেন্দ্র করে ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও জালটাকার কারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্রের অপতৎপরতা বেড়ে থাকে। এদের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ অতিরিক্ত ফোর্স গোয়েন্দা নজরদারিসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মতো ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কিন্তু ছিনতাইয়ের নতুন প্রবণতা বিকাশকর্মীদের ওপর হামলা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেই।
এ ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য, তাদের বলা আছে এক লাখের বেশি টাকা স্থানান্তর বা বহনের সময় পুলিশকে জানাতে। কিন্তু সেটি তারা করছে না।
এদিকে দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে তোলা লাখ লাখ বিকাশ এজেন্ট থেকে টাকা সংগ্রহকারী কর্মীদের নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেই বিকাশের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের পক্ষ থেকেও। এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করলে তারা কোনো জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকায় মহিলা অধিদপ্তরের সামনে জয়িতা টেলিকম নামের একটি বিকাশের দোকান খুলেছেন মো. শাহাদৎ হোসেন ও ইলিয়াস হোসেন ইমন নামের দুই বন্ধু। তারা বলেন, ‘ঈদের আগে বিভিন্ন স্থানে বিকাশকর্মীরা ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। বড় ঘটনাগুলোই কেবল পত্রিকায় আসে। আর্থিক লেনদেনের মতো ব্যবসা করলেও আমাদের তেমন কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন-তখন যে কেউ এসে আমাদের ক্ষতি করতে পারে।’
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে আমরা জনসাধারণকে বলে থাকি পুলিশের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য। কোনো বিকাশকর্মী পুলিশের সহযোগিতা চাইলে সেই সুবিধা পাবেন।’
গত এক মাসে কজন বিকাশকর্মী ছিনতাইকারীর খপ্পড়ে পড়েছেন সেই পরিসংখ্যান আছে কি না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যেসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়, সেসব ঘটনার তথ্য পুলিশের কাছে থাকে। কিন্তু অনেক ঘটনা পুলিশকে জানানো হয় না। সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পুলিশের কাছে থাকে না।
মন্তব্য চালু নেই