‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান’
খুব কম মানুষই পারেন, নিজের দেশ-জাতি আর আঞ্চলিকতার গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বজনীন হতে। কেউ কেউ পারেন। যারা পারেন, তাদের অতিক্রম করতে হয় জাতীয়তার সীমানা। অতিক্রম করতে হয় সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডী। অতিক্রম করতে হয়, হিংসা-দ্বেষের সংস্কৃতি। যারা পারেন, তারা ইতিহাসের অংশীদার হয়ে যান। নিউজিল্যান্ডের এমনই এক ডাক্তার গেল ৩৭ বছর ধরে হয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের অলিখিত ইতিহাসের অংশ। তার শেষকৃত্যে ঢল নামে মানুষের। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণের পরিচয় ভুলে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-সাদা-কালো-নারী-পুরুষ সবাই সামিল হয়েছিলেন সেই শেষকৃত্যে।
মানব সেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত নিউজিল্যান্ডের এডরিক বেকার। পেশায় একজন ক্যাথলিক চিকিৎসক। ১৯৭৯ সালে কালিয়াকৈরি হেলথ কেয়ার প্রজেক্টের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে আসেন তিনি। দূর পরবাসে এসে একদল অচেনা অসহায় মানুষের সেবা করে কাটিয়ে দেন জীবনের শেষ ৩৭টি বছর। বাংলাদেশে এসেই এদেশের মানুষকে ভালোবাসে ফেলেন এডরিক। বাংলাদেশিরাও তাকে আপন করে নেয়। বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘ডাক্তার ভাই’ হিসেবে। সম্প্রতি ৭৪ বছর বয়সে অনেকটা নিভৃতেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ‘ডাক্তার ভাই’।
টাঙ্গাইলেই অনুষ্ঠিত হয় এডরিক বেকারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান। পেশায় চিকিৎসক এ মানুষটি মন জয় করে নিয়েছিলেন সব ধর্মের মানুষের। বিদায় বেলায়ও গেয়ে গেছেন ঐকতান। আর সেকারণেই হয়তোবা প্রিয় ডাক্তার ভাইয়ের শেষকৃত্যে ভীড় জমান সব ধর্মের মানুষ। প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে ভীড় জমান তারা।
বাংলাদেশের প্রতি এই মানুষটির ভালোবাসা এবং তাকে আপন করে নেয়া বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশিয়া নিউজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
ময়মনসিংহ এলাকার বিশপ পল কুবি এশিয়া নিউজকে জানায়, খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন এডরিক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তার অবদান অনেক। মানুষকে ভালোবাসার এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত ছিলেন এডরিক।
বাংলাদেশের প্রতি তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে লেখালেখি করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মালম্বীদের মাঝে খুবই জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি।
তার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করতে এসে তার ভালোবাসা এবং বিনয়ের কথা স্মরণ করেন অনেকেই। খ্রিষ্টান হওয়ার পরও সকল ধর্মের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও উদারতা দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলো গ্রামবাসী।
রাজিয়া সুলতানা নামে এক মুসলিম নারী জানান, ‘ড. বেকারের মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি। বাংলাদেশের ডাক্তারদের তার কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।
ইত্যাদি’র পরিচালক হানিফ সংকেত বলেন, ‘এডরিক বেকার অসহায়দের সহায়তার এক নতুন অর্থ দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি যেন পরকালেও সুখে থাকেন।’
২০১১ সালে ড, এডরিক বেকারকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন হানিফ সংকেত। মূলত সেই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেই দেশবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি এবং বাংলাদেশ সরকার তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে।
এডরিক বেকারের একজন রোগী মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘ক্যাথলিক এই চিকিৎসক বিদেশি হওয়ার পরেও আমাদের দেশকে যেন আমাদের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছেন।’
মন্তব্য চালু নেই