আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়

মোদি-খালেদা সেতুবন্ধন

প্রতিবেশী ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের হাল নির্ভর করে এ দেশের ক্ষমতাসীন দলের ওপর। কার্যত ভারত সম্পর্কে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন মনোভাবের কারণে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক একটা মেরুকরণের মধ্যেই আবর্তিত। কিন্তু ভারতে এবার সরকার বদলের পর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে উঠছে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। দুদেশের স্বার্থেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মাঝে এ সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে। কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা গতকাল শনিবার সেতুবন্ধন শিরোনামে এ সম্পর্কিত একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। পাঠকদের জন্য সম্পাদকীয়টি হুবহু তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) নেতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিজেপি নেতৃত্বকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল পাঠাইবার আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। আসন্ন দুর্গোৎসবের সময়কেই এই আমন্ত্রিত সফরের জন্য বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে খালেদার এই আমন্ত্রণ আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মনে হইতে পারে। কিন্তু ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তাঁহার বাংলাদেশ সফরকালে বিরোধী নেত্রী খালেদার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সম্ভবত তাহারই প্রতিদানস্বরূপ এই আমন্ত্রণ। দুর্গাপূজার লগ্নটিকে সফরের জন্য বাছিয়া দিবার কারণ, ইহা বাংলাদেশের হিন্দুদের বৃহত্তম উৎসব। বেগম জিয়া সম্ভবত বিজেপি নেতৃত্বকে দেখাইতে চাহেন, তাঁহাকে যতটা ভারত-বিরোধী বলিয়া গণ্য ও প্রচার করা হয়, তিনি তাহা নহেন। ভারতের সহিত সুসম্পর্কের মূলে দুই দেশের রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ও ফলপ্রসূ হইতে পারে বলিয়া তাঁহার ধারণা। বেগম জিয়ার এই আমন্ত্রণ কূটনৈতিকভাবে কুশলী চাল হইলেও দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্কের বুনিয়াদ সুদৃঢ় করিতে ইহা সহায়ক হইতে পারে।

সাধারণত দেখা যায়, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী ও সচিবরা বাংলাদেশ সফরে গেলে সেখানকার শাসক দলের সঙ্গেই যাবতীয় আলাপ-আলোচনা চালান। বাংলাদেশের রাজনীতি কিন্তু কার্যত দ্বিদলীয়। শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি-র মধ্যেই ক্ষমতার মেরু ঘোরাফেরা করিয়া থাকে। তাই বিরোধী দল ক্ষমতাসীন নয় বলিয়া তাহার নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা ভ্রান্ত কূটনীতি। বেগম জিয়ার শাসনকালও অবশ্য এ জন্য কতকাংশে দায়ী। ভারতের সহিত সুসম্পর্ক রচনায় অতীতে যে তাঁহার প্রচেষ্টার অভাব থাকিয়াছে, তাহাতে সংশয় নাই। রাজধানী ঢাকাকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত করিয়া এবং ওই জঙ্গিদের ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী’ আখ্যা দিয়া প্রধানমন্ত্রী খালেদার সরকার স্বভাবতই নয়াদিল্লির বিরাগভাজন হয়। তুলনায় শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামি লিগ সরকার অনেক বেশি ভারতবন্ধুর ভূমিকা পালন করিয়াছে। কিন্তু ভারত জানে, যেমন জানেন বেগম জিয়াও যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পুনরায় বিএনপি ক্ষমতাসীন হইতে পারে এবং সেই দল ও তাহার সর্বময় কর্ত্রীর সহিত সুসম্পর্ক বজায় রাখা আবশ্যক। একই কারণে খালেদাও বিজেপির সহিত সুসম্পর্ক গড়িতে চাহেন।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তাঁহার নির্বাচনী প্রচারের সময় দুইটি বিষয় উল্লেখ করিয়াছিলেন। এক বাংলাদেশ হইতে অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে স্থান নাই, যদিও শরণার্থীরা স্বাগত। দুই, শরণার্থী তাহারাই, যাহারা দুর্গা-মাইয়ের পূজা করে, অর্থাত্‌ বাংলাদেশ হইতে বিতাড়িত হিন্দুরা। বাংলাদেশি হিন্দুদের সেই সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা-মাইয়ের পূজার সময়েই খালেদা বিজেপির প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। সেই সঙ্গে জানাইতে ভুলেন নাই যে, তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা অনেক হ্রাস পায় এবং ফলত ভারতে তাহাদের শরণার্থী হওয়ার ঘটনাও কমিয়া আসে। বেগম জিয়া যে বিজেপির নরেন্দ্র মোদীকে আশ্বস্ত করিতে চাহেন, তাহা স্পষ্ট। তিনি ভবিষ্যতের নিরিখে বৃহত্তম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত মৈত্রীর সেতুবন্ধনে আগ্রহী। সুলক্ষণ।



মন্তব্য চালু নেই