‘বাস্তবায়ন অসম্ভব মেয়র প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি’

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের ইশতেহারের অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিই প্রচলিত সিটি করপোরেশন আইনে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রচলিত আইনের সংশোধন ও নগর সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল তাদের (প্রার্থী) এ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

তবে প্রার্থীদের এমন প্রতিশ্রুতিকে সাধুবাদও জানিয়েছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, প্রতিশ্রুতিগুলো যদি শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যে না থেকে আইনের সংস্কার এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে, তাহলেই নগরবাসীর প্রকৃত উন্নয়ন হবে।

আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রায় সকল মেয়র প্রার্থীই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের ঢঙে ঘোষণা করা এ সব ইশতেহারে প্রার্থীরা নগরের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিকার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মোটামুটি সবার ইশতেহারে ঢাকাকে বাসযোগ্য, নিরাপদ, যানজটমুক্ত, পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তোলার বিষয়টি উঠে এসেছে। একই সঙ্গে ঢাকাকে উন্নত বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তাতে।

প্রার্থীদের এ সব ইশতেহারে এমন কিছু প্রতিশ্রুতির বিষয় উঠে এসেছে যা কেবল মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব। স্থানীয় সরকার আইন (সিটি করপোরেশন)-২০১১ (সংশোধন) অনুযায়ী কোনো মেয়রের পক্ষে এ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এমনটি মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, নগর সেবার গুটিকয়েক রয়েছে সিটি করপোরেশনের হাতে আর অধিকাংশ সেবা অন্যান্য সেবা সংস্থার হাতে থাকায় সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা সীমিত। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন আইনের পরিবর্তন করে সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার গঠন না করলে কোনোভাবেই মেয়র প্রার্থীরা তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন যে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তার ৩ নম্বরে রয়েছে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ— প্রধান তিন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা।

অথচ সিটি করপোরেশনের বর্তমান আইনে এই তিন সেবা প্রদানের ক্ষমতা মেয়রদের দেওয়া হয়নি। রাজধানীতে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, যা স্থানীয় সরকারের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, যা কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডেসকো ও ডিপিডিসি নামের দু’টি ‍পৃথক সরবরাহ কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

সাঈদ খোকন তার চতুর্থ প্রতিশ্রুতিতে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ ও এই ব্যবস্থাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পঞ্চম প্রতিশ্রুতিতে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও নাগরিকের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক সিটি করপোরেশন এলাকার অন্তর্ভুক্ত মোট ৫৬টি সেবা সংস্থাকে শক্তিশালীভাবে সমন্বয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

উত্তর সিটি করপোরেশনের আরেক মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল তার নির্বাচনী ইশতেহারে খাদ্যে ভেজাল রোধ, সুলভ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন, বিনোদন, জনস্বাস্থ্য, ডিজিটাল সেবা, জননিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবিলা, নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অবশ্য ইশতেহার ঘোষণার সময় তাবিথ আউয়াল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমিও জানি সিটি করপোরেশন মেয়রের পক্ষে ইশতেহারের সকল প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস তার নির্বাচনী ইশতেহার এখনও প্রকাশ করেননি।

মেয়র প্রার্থীদের ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোকে সাধুবাদ জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ  বলেন, ‘আমি প্রার্থীদের ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই, কারণ তারা তাদের ইশতেহারে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সব প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে তারা রাজধানীর বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন।

যেমন প্রত্যেক প্রার্থীই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যানজটমুক্ত, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন নগর উপহার দিবেন। এটা মোটামুটি প্রার্থীরা অবগত যে এই তিনটি বিষয় রাজধানীর সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখন প্রচলিত আইনে (সিটি করপোরেশন) যদি তাদের এ সব বিষয়ে কিছু করার না থাকে তাহলে অবশ্যই আইন পরিবর্তন বা সংশোধনের দাবি তাদেরই তুলতে হবে।’

তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, ‘প্রচলিত আইনে তাদের কী ক্ষমতা আছে সেটা বড় বিষয় নয়। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন সেটাই বড় বিষয়। এখন তারা যেভাবে জনগণের সম্পৃক্ততা চাচ্ছেন নির্বাচনে জয়ী হতে। আমি মনে করি প্রত্যেক প্রার্থী জয়ী হতে পারুক আর না পারুক তাদের উচিত হবে তাদের প্রত্যেকের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেওয়া, আর এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাবিথ আউয়াল উত্তরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা জানি কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কিন্তু চট্টগ্রামে মহিউদ্দীন মেয়র থাকা অবস্থায় সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে একটি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই প্রচেষ্টা থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কেউ ভূমিকা রাখতে পারে।’

এ সব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, ‘এ পর্যন্ত মেয়র প্রার্থীরা যে সব প্রতিশ্রুতি তাদের ইশতেহারে দিয়েছেন সেগুলো দুইভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। না হলে বর্তমান সিটি করপোরেশনের কাঠামোতে সম্ভব নয়। প্রথমত, বর্তমান কাঠামোতে এ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে সরাসরি সহযোগিতা করতে হবে।

যা সিটি করপোরেশনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নয়, সরকারের কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যথায় সিটি করপোরেশনের আইন পরিবর্তন করে এর কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। সিটি করপোরেশন দিয়ে কখনো নগরের সকল সেবা নিশ্চিত করা সম্ভর নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নগর সরকার গঠন করতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবীব  বলেন, ‘আমরা যদি লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনির মতো উন্নত নগরগুলো দেখি তাহলে দেখব সেখানে মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সিটি গভর্নমেন্ট নয়, সিটি করপোরেশন রয়েছে। এটাকে আমরা স্থানীয় সরকার বললেও প্রকৃতপক্ষে এটার কোনো ক্ষমতা আমরা দেখি না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে বাতি লাগানো আর জ্বালানোর ক্ষমতা আছে তাদের, কিন্তু ল্যাম্পপোস্টটা পরিবর্তন করতে হলে করবে ডিপিডিসি না হয় ডেসকো। তাহলে মেয়র কীভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করবে?’

একই বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (সিইউএস) চেয়ারম্যান নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম  বলেন, ‘স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দাবি আমরা সব সময় করেছি।

যদি কেউ রাজধানীর অর্ধ শতাধিক সেবা সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে চান তাহলে অবশ্যই একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং (কেন্দ্রীয় তদারকি) ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর সেটা অবশ্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হতে হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত হলেও প্রচলিত আইন অনুযায়ী এর ক্ষমতা খুবই সীমিত এবং এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একজন সিটি মেয়রের সম্মানের কথা চিন্তা করে হয়ত কোনো থানার ওসি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অনুরোধ রাখতে পারেন। কিন্তু মেয়রের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভূমিকা রাখে। ডিএমপি কখনো সিটি করপোরেশনের অধীন কোনো সংস্থা না। যদি নগর সরকার গঠন করা সম্ভব হয় তাহলে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ রাজধানীর সকল সেবাদানকারী সংস্থা মেয়রের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।’

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন  বলেন, এখানে মেয়রকে নগর পিতা বলা হলেও নগরের শাসন তিনি একা করেন না। আগে করতেন একজন মেয়র এখন বেড়ে আরেকজন হয়েছে। এর মধ্যে তো রাজউক পিতা, ওয়াসা পিতা, ডেসকো পিতা রয়েছে। নগর পিতা রাস্তা বানায় আর ওয়াসা পিতা এসে তা খুঁড়ে রাখে। সন্তান আছে সমস্যায়।

তাদের মধ্যে কতটুকু সমন্বয় আছে সেটা নগরের দিকে তাকালে বোঝা যায়। বর্ষার শুরুতে ওয়াসার কাজ হল রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা। আবার রাস্তায় সিগন্যাল বাতি লাগায় সিটি করপোরেশন আর হাত উঁচু করে গাড়ি থামিয়ে রাখে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ। ঢাকাতে যে কয়টি ফ্লাইওভার হয়েছে তার কয়টা সিটি করপোরেশন বানিয়েছে? মাত্র একটা তাও অর্থায়নে প্রাইভেট কোম্পানি (গুলিস্তান ফ্লাইওয়ার)। মেট্রোরেল করছে কেন্দ্রীয় সরকার, সিটি করপোরেশন না।’

স্থপতি মোবাশ্বের বলেন, ‘এখন মেয়ররা যে সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জনগণও মনে করেন এগুলো তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নগর সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো মেয়রই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।



মন্তব্য চালু নেই