মেলায় নতুন বইয়ের কমিশনে শুভঙ্করের ফাঁকি

গতবারের চেয়ে এবার বইমেলায় নতুন বইয়ের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। কাগজ, কালি ও প্রকাশনা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। অন্যদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, বাংলা একাডেমির নিয়ম-কানুন না মেনে প্রকাশকরা ইচ্ছেমতো বইয়ের গায়ে দাম লিখে রাখছেন। ফলে ২০ শতাংশ কমিশন দিলেও আসলে ঠকছে ক্রেতা সাধারণ।

বইমেলার ১৬তম দিনে সোমবার একাডেমি চত্বরে শিশুকর্নারে কথা হয় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ইশতিয়াকের সঙ্গে। বইমেলায় তিনি শিশুতোষ সাহিত্য কিনতে এসেছিলেন। ইশতিয়াক বলেন, ‘বইয়ের গায়ের দাম তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি। বইকে আকর্ষণীয় করতে রঙিন প্রচ্ছদ ও কারুকাজ করা হচ্ছে। ফলে বইয়ের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব খরচ মূলত পাঠকদের কাছ থেকেই নেয়া হচ্ছে।’

একই কথা জানালেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফাইয়াজ ইমন। তিনি বলেন, ‘পাঠকের হাতে সুপাঠ্য বই তুলে দেয়াই প্রকাশকের কাজ। কিন্তু এখন বইয়ের রঙ-চঙা ভাব দেখে কোনটা সুপাঠ্য আর কোনটা পাঠের অনুপযোগী সেটা বোঝার উপায় নেই। বইয়ের প্রকাশনা ব্যয় বাড়লে পাঠকদের বই কেনার খরচাও বেড়ে যাচ্ছে।’

ফাইয়াজ এজন্য জনপ্রিয় লেখকদের বই সবার হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য পেপার ব্যাকে প্রকাশ করার জন্য প্রকাশকদের প্রতি আহ্বান জানান।

বইমেলা উপলক্ষে বাংলা বাজার ও এর আশেপাশের ছাপাখানা, বাইন্ডিং, কাটিং, সেলাই কারখানাগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। পুরান ঢাকার কাঠের পুলের একটি বাইন্ডিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আশরাফ আলী জানান, একটি বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য সাধারণত ৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। নামি-দামি লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদের খরচ আরো বেশি। বইয়ের অঙ্গসজ্জার জন্য খরচ বাড়লে সেটা বইয়ের গায়ের দামে প্রভাব ফেলে। এছাড়া বাইন্ডিং শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও গতবারের তুলনায় খরচ কিছুটা বেড়েছে।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনির দাবি, গতবারের তুলনায় বইয়ের দাম খুব একটা বাড়েনি। যা বেড়েছে তা সঙ্গত কারণেই। প্রকাশনা খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

বাংলা একাডেমির নীতিমালা অনুসারে বইমেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে বই বিক্রি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গায়ের দাম থেকে ২৫ ভাগ কমিশন বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ কমিশনে বই বিক্রি করছে। এটা পাঠকদের জন্য সুখবর হলেও এর পেছনের কারণটা ভিন্ন। কারণটা ব্যাখ্যা করলেন বনলতা প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী আমেনা আফতাব। তিনি জানান, মূলত তারা যেসব ছাপাখানা থেকে বইয়ের প্রুফ, প্রিন্টিং, বাইন্ডিং করান সেসব প্রতিষ্ঠান বইয়ের গায়ের দাম বেশি নির্ধারণ করে দেয়। ফলে বইয়ের ক্রেতাদের সুবিধার জন্য ২৫ ভাগের চেয়ে বেশি কমিশন দেয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি।

সাহস পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হুদা রতন বলেন, ‘প্রতিবছরই নতুন বইয়ের দাম বাড়ে। এই দাম বৃদ্ধি পাওয়াটা যৌক্তিক। কেননা, প্রকাশনা শিল্পের খরচ বেড়েছে। গেলবারের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছে।’

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, ‘বই প্রকাশনার মূল উপকরণ কাগজ। বইমেলা এলেই কাগজ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। বইয়ের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কাগজের ওপর ভর্তুকি দেয়া হোক।’

এর জন্য মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিকেও দুষলেন আলমগীর সিকদার। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি গতবছরের তুলনায় স্টল ভাড়া বাড়িয়েছে। প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাপ করে নতুন প্রকাশিত বইয়ের দাম শতকরা ২০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে।

বইয়ের দাম বাড়ানোর ফলে ক্রেতা-সাধারণের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে কি না? এমন প্রশ্নে লোটন বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাবটা সারা পৃথিবীব্যাপী। সব কিছুরই দাম বাড়ছে। ক্রেতারা এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত। তাই নুতন বইয়ের দাম বাড়ানোর ফলে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট নয়।’



মন্তব্য চালু নেই